পরিশিষ্ট

শিল্পবিদ্যালয়। ইহাদিগকে ফিরাইয়া দিলে দেশে যে অমঙ্গল ঘটিবে তাহার ভার আমরা বহন করিতে পারিব না।

অনেকের মনে এ প্রশ্ন উঠিবে, দেশের কাজ হিসাবে সাহিত্যপরিষদের কাজটা এমনি কী একটা মস্ত ব্যাপার! এইরূপ প্রশ্ন আমাদের দেশের একটা বিষম বিপদ। য়ুরোপ-আমেরিকা তাহার প্রকাণ্ড কর্মশালা লইয়া আমাদের চোখের সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, তাই দেখিয়া আমাদের অবস্থা বড়ো হইবার পূর্বেই আমাদের নজর বড়ো হইয়া উঠিয়াছে। যে কাজ দেখিতে ছোটো তাহাতে উৎসাহই হয় না; এইজন্য বীজরোপন করা হইল না, একেবারে অস্ত বনস্পতি তুলিয়া আনিয়া পুঁতিয়া অন্য দেশের অরণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করিবার জন্য বাস্ত হইয়া পড়িয়াছি। এ তো প্রেমের লক্ষ নহে, এ অহংকারের লক্ষণ। প্রেমের অসীম ধৈর্য,কিন্তু অহংকার অত্যন্ত ব্যস্ত। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, ইংরেজ নানামতে আমাদিগকে অবজ্ঞা দেখাইয়া আমাদের অহংকারকে অত্যন্ত রাঙা করিয়া তুলিয়াছে। আমাদের এই কথাই কেবল বলিবার প্রবৃত্তি হইতেছে, আমরা কিছুতেই কম নই। এইজন্য আমরা যাহা-কিছু করি সেটাকে খুবই বড়ো করিয়া দেখাইতে না পারিলে আমাদের বুক ফাটিয়া যায়। একটা কাজ ফাঁদিবার প্রথমেই তো একটা খুব মস্ত নামকরণ হয়; নামের সঙ্গে ‘ন্যাশনাল’ শব্দটা কিংবা ঐরকমের একটা বিদেশী বিড়ম্বনা জুড়িয়া দেওয়া যায়। এই নামকরণ-অনুষ্ঠানেই গোড়ায় ভারি একটি পরিতৃপ্তি বোধ হয়। তার পরে বড়ো নামটি দিলেই বড়ো আয়তন না দিলে চলে না; নতুবা বড়ো নাম ক্ষুদ্র আকৃতিকে কেবলই বিদ্রূপ করিতে থাকে। তখন নিজের সাধ্যকে লঙ্ঘন করিতে চাই। তক্‌মাওয়ালা লাগামের খাতিরে ওয়েলারের জুড়ি না হইলে মুখরক্ষা হয় না—এ দিকে ‘অদ্যভক্ষ্যোধনুর্‌গুণঃ’। যেমন করিয়া হউক, একটা প্রকাণ্ড ঠাট গড়িয়া তুলিতে হয়; ছোটোকে ক্রমে ক্রমে বড়ো করিয়া তুলিবার, কাঁচাকে দিনে দিনে পাকা করিয়া তুলিবার যে স্বাভাবিক প্রণালী তাহা বিসর্জন দিয়া যত বড়ো প্রকাণ্ড স্পর্ধা খাড়া করিয়া তুলি তত বড়োই প্রকাণ্ড ব্যর্থতার আয়োজন করা যায়। যদি বলি ‘গোড়ার দিকে সুর আর-একটু নামাইয়া ধরো-না কেন’ তবে উত্তর পাওয়া যায়, তাহাতে লোকের মন পাইব না। হায় রে লোকের মন! তোমাকে পাইতেই হইবে বলিয়া পণ করিয়া বসাতেই তোমাকে হারাই। তোমাকে চাই না বলিবার জোর যাহার আছে সেই তোমাকে জয় করে। এইজন্যই যে ছোটো সেই বড়ো হইতে থাকে; যে গোপনে শুরু করিতে পারে সেই প্রকাশ্যে সফল হইয়া উঠে।

সকল দেশেরই মহত্ত্বের ইতিহাসে যেটা আমাদের চক্ষুর গোচর তাহা দাঁড়াইয়া আছে কিসের উপরে? যেটা আমাদের চক্ষুর গোচর নহে তাহারই উপর। আমরা যখন নকল করিতে বসি, তখন সেই দৃষ্টিগোচরটারই নকল করিতে ইচ্ছা যায়; যাহা চোখের আড়ালে আছে তাহা তো আমাদের মনকে টানে না। এ কথা ভুলিয়া যাই, যাহাদের নামধাম কেহই জানে না দেশের সেই শতসহস্র অখ্যাত লোকেরাই নিজের জীবনের অজ্ঞাত কাজগুলি দিয়া যে স্তর বাঁধিয়া দিতেছে তাহারই উপরে নামজাদা লোকেরা বড়ো বড়ো ইমারত বানাইয়া তুলিতেছে। এখন যে আমাদিগকে ভিত কাটিয়া গোড়াপত্তন করিতে হইবে—সে ব্যাপারটা তো আকাশের উপরকার নহে, তাহা মাটির নিচেকার, তাহার সঙ্গে ওয়েস্ট্‌মিনিষ্টার হলের তুলনা করিবার কিছুই নাই। গোড়ায় সেই গভীরতা, তার পরে উচ্চতা। এই গভীরতার রাজ্যে স্পর্ধা নাই, ঘোষণা নাই; সেখানে কেবল নম্রতা অথচ দৃঢ়তা, আত্মগোপন এবং আত্মত্যাগ। এই-সমস্ত ভিতের কাজে, ভিতরের কাজে, মাটির সংস্রবের কাজে আমাদের মন উঠিতেছে না; আমরা একদম চুড়ার উপর জয়ডঙ্কা বাজাইয়া ধ্বজা উড়াইয়া দিতে চাই। স্বয়ং বিশ্বকর্মাও তেমন করিয়া বিশ্বনির্মাণ করেন নাই। তিনিও যুগে যুগে অপরিষ্ফুটকে পরিষ্ফুট করিয়া তুলিতেছেন।

তাই বলিতেছি, সকল দেশেই গোড়ার কাজটা ঠিকমত চলিতেছে বলিয়াই ডগার কাজটা রক্ষা পাইতেছে; নেপথ্যের ব্যবস্থা পাকা বলিয়াই রঙ্গমঞ্চের কাজ দিব্য চলিয়া যাইতেছে। স্বাস্থ্যরক্ষা অন্ন-উপার্জন জ্ঞানশিক্ষার কাজে দেশ ব্যাপিয়া হাজার-হাজার লোক মাটির নিচেকার শিকড়ের মতো প্রাণপণে লাগিয়া আছে বলিয়াই সে-সকল দেশে সভ্যতার এত শাখাপ্রশাখা, এত পল্লব, এত ফুল-ফলের প্রাচুর্য। এই গোড়াকার অত্যন্ত সাধারণ কাজগুলির মধ্যে যে-কোনো একটা কাজ করিয়া তোলাই যে আমাদের পক্ষে