প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
এইজন্যই বাংলাদেশের ভাষাতত্ত্ব পুরাবৃত্ত গ্রাম্যকথা প্রভৃতি দেশের সমস্ত ছোটো-বড়ো বৃত্তান্ত সংগ্রহ করিবার জন্য সাহিত্যপরিষদ যখন দেশের সভার একটি ধারে আসিয়া আসন লইল আমরা আনন্দে ও গৌরবে তাহার অভিষেককার্য করিয়াছিলাম।
যদি বলেন ‘সাহিত্যপরিষদ এত দিনে কী এমন কাজ করিয়াছে’ তবে সে কথাটা ধীরে বলিবেন এবং সংকোচের সহিত বলিবেন। আমাদের দেশের কাজের বাধা যে কোথায় তাহা আমরা তখনই বুঝিতে পারি যখনই আমরা নিজেরা কাজ হাতে লই; সে বাধা আমরা নিজেরা, আমরা প্রত্যেকে। যে কাজকে আমরা আমাদের কাজ বলিয়া বরণ করি তাহাকে আমরা কেহই আমার কাজ বলিয়া গ্রহণ করিতে এখনো শিখি নাই। সেইজন্য আমরা সকলেই পরামর্শ দিতে অগ্রসর হই, কেহই সাহায্য করিতে প্রস্তুত হই না; ত্রুটি দেখিলে কর্মকর্তার নিন্দা করি, অকর্মকর্তার অপবাদ নিজের উপর আরোপ করি না; ব্যর্থতা ঘটিলে এমনভাবে আস্ফালন করি যেন কাজ নিষ্ফল হইবে পূর্বেই জানিতাম এবং সেইজন্যই অত্যন্ত বুদ্ধিপূর্বক নির্বোধের উদ্যোগে যোগ দিই নাই। আমাদের দেশে জড়তা লজ্জিত নহে, অহংকৃত; আমাদের দেশে নিশ্চেষ্টতা নিজেকে গোপন করে না, উদ্যোগকে ধিক্কার দিয়া এবং প্রত্যেক কাজের খুঁত ধরিয়া সে নিজের শ্রেষ্ঠতা প্রমাণ করিতে চায়। এইজন্য আমাদের দেশে এ দৃশ্য সর্বদাই দেখিতে পাই যে, দেশের কাজ একটিমাত্র হতভাগ্য টানিয়া লইয়া চলিয়াছে, হাওয়া এবং স্রোত দুই উল্টা, এবং দেশের লোক তীরে বসিয়া দিব্য হাওয়া খাইতে খাইতে কেহ-বা প্রশংসা করিতেছে, কেহ-বা লোকটার অক্ষমতা ও বিপত্তি দেখিয়া নিজেকে ধন্যজ্ঞান করিতেছে।
এমন অবস্থায় দেশের অতি ক্ষুদ্র কাজটিকেও গড়িয়া তোলা কত কঠিন সে কথা আমরা যেন প্রত্যেকে বিবেচনা করিয়া দেখি। একটা ছোটো ইস্কুল, একটা সামান্য লাইব্রেরী, একটা আমোদ করিবার দল বা একটা অতি ছোটো রকমেরও কাজ করিবার ব্যবস্থা আমরা জাগাইয়া রাখিতে পারি না। সমুদ্রে জল থই-থই করিতেছে, তাহার এক ফোঁটা মুখে দিবার জো নাই; আমাদের দেশেও ষষ্ঠির প্রসাদে মানুষের অভাব নাই, কিন্তু কর্তব্য যখন তাহার পতাকা লইয়া আসিয়া শঙ্খধ্বনি করে তখন চারি দিকে চাহিয়া একটি মানুষ দেখিতে পাওয়া যায় না।
এই-যে আমাদের দেশে কোনোমতেই কিছুই আঁট বাঁধে না, সংকল্পের চারি দিকে দল জমিয়া উঠে না, কোনো আকস্মিক কারণে দল বাঁধিলেও সকালের দল বিকাল বেলায় আলগা হইয়া আসে, এইটি ছাড়া আমাদের দেশে আর দ্বিতীয় কোনো বিপদ নাই। আমাদের এই একটিমাত্র শত্রু। নিজের মধ্যে এই প্রকাণ্ড শূন্যতা আছে বলিয়াই আমরা অন্যকে গালি দিই। আমরা কেবলই কাঁদিয়া বলিতেছি: আমাদিগকে দিতেছে না। বিধাতা আমাদের কানে ধরিয়া বলিতেছেন: তোমরা লইতেছ না। আমারা একত্র হইব না, চেষ্টা করিব না, কষ্ট সহিব না, কেবলই চাহিব এবং পাইব—কোনো জাতির এতবড়ো সর্বনেশে প্রশ্রয়ের দৃষ্টান্ত জগৎসংসারের ইতিহাসে তো আজ পর্যন্ত দেখা যায় নাই। তবু কেবল আমাদেরই জন্য বিশ্ববিধাতার একটি বিশেষ বিধির অপেক্ষায় আকাশে চাহিয়া বসিয়া আছি। সে বিধি আমাদের দেশে কবে চলিবে জানি না, কিন্তু বিনাশ তো সবুর করিবে না। সবুর করেও নাই; অনশন মহামারী অপমান গৃহবিচ্ছেদ চারি দিকে জাগিয়া উঠিয়াছে। রুদ্রদেব বজ্র-হাতে আমাদের অনেক কালের পাপের হিসাব লইতে আসিয়াছেন; খবরের কাগজে মিথ্যা লিখিতে পারি, সভাস্থলে মিথ্যা বলিতে পারি, রাজার চোখে ধূলা দিতে পারি, এমন-কি, নিজেকে ফাঁকি দেওয়াও সহজ; কিন্ত তাঁহাকে তো ভুল বুঝাইতে পারিলাম না। যাহার উপরেই দোষারোপ করি-না কেন, রাজাই হোক বা আর যেই হোক, মরিতেছি তো আমরাই; মাথা তো আমাদেরই হেঁট হইতেছে এবং পেটের ভাত তো আমাদেরই গেল। পরের কর্তব্যের ত্রুটি অন্বেষণ করিয়া আমাদের শ্মশানের চিতা তো নিবিল না।
আরামের দিনে নানাপ্রকার ফাঁকি চলে, কিন্তু মৃত্যুসহচর বিধাতা যখন স্বয়ং দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন তখন আজ আর মিথ্যা দিয়া হিসাব-পূরণ হইবে না। এখন আমাদের কঠোর সত্যের দিন আসিয়াছে। আজ আমরা যে-কোনো কাজকেই গ্রহণ করি না কেন, সকলে মিলিয়া সে কাজকে সত্য করিয়া তুলিতে হইবে। দেশের যেকোনো যথার্থ মঙ্গল-অনুষ্ঠানকে আমরা উপবাসী করিয়া ফিরাইব