পরিশিষ্ট

এমন ভরসা হয়। এইরকম সময়ে যাহা অনপেক্ষিত তাহাও দেখা দেয়, যাহাকে আশা করিবার কোনো কারণ ছিল না তাহাও হঠাৎ সম্ভব হইয়া উঠে, আমাদের প্রত্যেকের শক্তি সামান্য হইলেও সমস্ত সমাজের বেগে ক্ষণে ক্ষণে অসাধ্যসাধন হইতে থাকে।

আজ আমাদের সাহিত্যপরিষদেরও আশা বাড়িয়া গেছে। এই-যে এখানে নানা জেলা হইতে আমরা বাঙালি একত্র হইয়াছি, এখানে শুধু একটা মিলনের আনন্দেই এই সম্মিলনকে শেষ করিয়া দিয়া যাইব এমন আমরা মনে করি না; হয়তো এই-বারেই, ফল যেমন যথাসময়ে ডাল ছাড়িয়া ঠিকমত জমিতে পড়ে ও গাছ হইবার পথে যায়, সাহিত্যপরিষদও সেইরূপ নিজেকে বৃহৎ বাংলাদেশের মধ্যে রোপিত করিবার অবসর পাইবে। এবার হয়তো সে বৃহত্তর জন্ম লাভ করিবার জন্য বাহির হইয়াছে। আপনাদের আহ্বান শুধু সমাদরের আহ্বান নহে, তাহা সফলতার আহ্বান। আমরা তো এইমত আশা করিয়াছি।

যদি আশা বৃথাই হয়, তবু মিলনটা তো কেহ কাড়িয়া লইবে না; বুদ্ধিমান কবি তো বলিয়াছেন যে, মহাবৃক্ষের সেবা করিলে ফল যদি-বা না পাওয়া যায়, ছায়াটা পাওয়া যাইবেই। কিন্তু ঐটুকু নেহাৎপক্ষের আশা লইয়াই আমরা সন্তুষ্ট হইতে পারিব না। আমরা এই কথাই বলিব, আচ্ছা, আজ যদি বা শুধু ছায়াই জুটিল, নিশ্চয়ই কাল ছায়াও পাইব, ফলও ধরিবে; কোনোটা বাদ দিব না। সফলতা সম্বন্ধে আধা-আধি রফানিষ্পত্তি করা কোনোমতেই চলিবে না। বহরমপুরের ডাকে আজ আমরা সাহিত্যপরিষদ অত্যন্ত লোভ করিয়াই এখানে আসিয়া জুটিয়াছি: শুধু আহার দিয়া বিদায় করিলে নিন্দার বিষয় হইবে, দক্ষিণা চাই। সেই দক্ষিণার প্রস্তাবটাই আজ আপনাদের কাছে পাড়িব।

আমার দেশকে আমি যত ভালোবাসি তার দশগুণ বেশি ভালোবাসা ইংরেজের কর্তব্য এ কথা আমরা মুখে বলি না, আমাদের ব্যবহারে তাহাই প্রকাশ পায়। এইজন্য ভারতবর্ষের হিতসাধনে বিদেশীর যত-কিছু ত্রুটি তাহা ঘোষণা করিয়া আমাদের শ্রান্তি হয় না, আর দেশীলোকের যে ঔদাসীন্য সে সম্বন্ধে আমরা একেবারেই চুপ। কিন্তু এ কথাটার আলোচনা বিস্তর হইয়া গেছে, এমন-কি আমার আশঙ্কা হয়, কথাটা আপনার অধিকারের মর্যাদা লঙ্ঘন করিয়া ছুটিয়াছে-বা। কথা-জিনিসটার দোষই ঐ—সেটা হাওয়ার জিনিস কিনা, তাই উক্তি দেখিতে দেখিতে অত্যুক্তি হইয়া উঠে। এখন যেন আমরা একটু বেশি তারস্বরে বলিতেছি ইংরেজের কাছ হইতে আমরা কিছুই লইব না। কেন লইব না? দেশের হিতের জন্য যেখানে যাহা পারি সমস্ত আদায় করিব। কেবল এইটুকু পণ করিব, সেই লওয়ার পরিবর্তে নিজেকে বিকাইয়া দিব না। যাহা বিশেষভাবে ইংরেজ গবর্মেন্টের কাছ হইতেই পাইবার তাহা ষোলো-আনাই সেইখান হইতেই আদায় করিবার পুরা চেষ্টাই করিতে হইবে। না করিলে সে তো নিতান্তই ঠকা। নির্‌বুদ্ধিতাই বীরত্ব নহে।

কিন্তু এই আদায় করিবার কোনো জোর থাকে না, আমরা যদি নিজের দায় নিজে স্বীকার না করি। দেশের যে-সকল কাজ আমরা নিজে করিতে পারি তাহা নিজেরা সাধ্যমত করিলে তবেই আদায় করাটা যথার্থ আদায় করা হয়, ভিক্ষা করা হয় না। এ নহিলে অন্যের কাছে দাবি করার আব্রুই থাকে না। কিছুকাল হইতে আমাদের সেই আব্রু একেবারে ঘুচিয়া গিয়াছিল; সেইজন্যই লজ্জাবোধটাকে এত জোর করিয়া জাগাইবার একটা একান্ত চেষ্টা চলিতেছে। সকলেই জানেন, জামেকায় ভূমিকম্পের উৎপাতের পর সেখানকার কিংস্টন শহরে ভারি একটা সংকট উপস্থিত হইয়াছিল। সেই সংকটের সময় আমেরিকার রণতরীর কাপ্তেন ডেভিস তাঁহার মানোয়ারি গোরার দল লইয়া উপকার করিবার উৎসাহবশত কিছু অতিশয় পরিমাণে সাহায্য করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, ইহা সেখানকার ঘোরতর দুর্যোগেও জামেকাদ্বীপের ইংরেজ অধ্যক্ষ সহ্য করিতে পারেন নাই। ইহার ভাবখানা এই যে, অত্যন্ত দুঃসময়েও পরের কাছে সাহায্য লইবার কালে নিজের ক্ষমতার অপমান করা চলে না; তা যদি করি তবে যাহা পাই তাহার চেয়ে দিই অনেক বেশি। পরের কাছে আনুকূল্য লওয়া নিতান্ত নিশ্চিন্তমনে করিবার নহে।

এইরূপ দান পাইয়া যদি ক্ষমতা বিক্রয় করি, আমার দেশের কাজ আমি করিবই এবং আমিই করিতে পারি এই পুরুষোচিত অভিমান যদি অনর্গল আবেদনের অজস্র অশ্রুজলধারায় বিসর্জন দিই, তবে তেমন করিয়া পাওয়ার ধিক্‌কার হইতে ঈশ্বর যেন