নৌকাডুবি
                        যথাকালে তরবারির সহিত রাজকন্যার গ্রন্থিবন্ধন হইয়া গেল। ইন্দ্রজিৎ সিং যৌতুক
                আনিয়া তাঁহার ভ্রাতৃবধূকে প্রণাম করিলেন। মদ্ররাজ্যের রণজিৎ এবং ইন্দ্রজিৎ যেন দ্বিতীয়
                রামলক্ষ্মণ ছিলেন। ইন্দ্রজিৎ আর্যা চন্দ্রার অবগুণ্ঠিত লজ্জারুণ মুখের দিকে তাকাইলেন না;
                তিনি কেবল তাঁহার নূপুরবেষ্টিত সুকুমার চরণযুগলের অলক্তরেখাটুকুমাত্র দেখিয়াছিলেন।
                        যথারীতি বিবাহের পরদিনেই মুক্তামালার-ঝালর-দেওয়া পালঙ্কে বধূকে লইয়া
                ইন্দ্রজিৎ স্বদেশের দিকে যাত্রা করিলেন। অশুভগ্রহের কথা স্মরণ করিয়া শঙ্কিতহৃদয়ে
                কাঞ্চীরাজ কন্যার মস্তকের উপরে দক্ষিণ হস্ত রাখিয়া আশীর্বাদ করিলেন, মাতা কন্যার
                মুখচুম্বন করিয়া অশ্রুজল সংবরণ করিতে পারিলেন না— দেবমন্দিরে সহস্র গ্রহবিপ্
                স্বস্ত্যয়নে নিযুক্ত হইল।
                        কাঞ্চী হইতে মদ্র বহুদূর, প্রায় এক মাসের পথ। দ্বিতীয় রাত্রে যখন বেতসা-নদীর
                তীরে শিবির রাখিয়া ইন্দ্রজিতের দলবল বিশ্রামের আয়োজন করিতেছে, এমন সময় বনের
                মধ্যে মশালের আলো দেখা গেল। ব্যাপারখানা কী জানিবার জন্য ইন্দ্রজিৎ সৈন্য পাঠাইয়া
                দিলেন।
                        সৈনিক আসিয়া কহিল, ‘কুমার, ইহারাও আর-একটি বিবাহের যাত্রিদল। ইহারাও
                আমাদের স্বশ্রেণীয় ক্ষত্রিয়, অস্ত্রোদ্‌বাহ সমাধা করিয়া বধূকে পতিগৃহে লইয়া চলিয়াছে। পথে
                নানা বিঘ্নভয় আছে, তাই ইহারা কুমারের শরণ প্রার্থনা করিতেছে; আদেশ পাইলে কিছুদূর
                পথ ইহারা আমাদের আশ্রয়ে যাত্রা করে।”
                        কুমার ইন্দ্রজিৎ কহিলেন, “শরণাপন্নকে আশ্রয় দেওয়া আমাদের ধর্ম। যত্ন করিয়া
                ইহাদিগকে রক্ষা করিবে।”
                        এইরূপে দুই শিবির একত্র মিলিত হইল।
                        তৃতীয় রাত্রি অমাবস্যা। সম্মুখে ছোটো ছোটো পাহাড়, পশ্চাতে অরণ্য। শ্রান্ত
                সৈনিকেরা ঝিল্লির শব্দে ও অদূরবর্তী ঝর্নার কলধ্বনিতে গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন।
                        এমন সময়ে হঠাৎ কলরবে সকলে জাগিয়া উঠিয়া দেখিল, মদ্র-শিবিরের ঘোড়াগুলি
                উন্মত্তের ন্যায় ছুটাছুটি করিতেছে— কে তাহাদের রজ্জু কাটিয়া দিয়াছে— এবং মাঝে মাঝে
                এক-একটা তাঁবুতে আগুন লাগিয়াছে ও তাহার দীপ্তিতে অমারাত্রি রক্তিমবর্ণ হইয়া উঠিয়াছে।
                        বুঝা গেল, দস্যু আক্রমণ করিয়াছে। মারামারি-কাটাকাটি বাধিয়া গেল— অন্ধকারে
                শত্রু-মিত্র ভেদ করা কঠিন; সমস্ত উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠিল। দস্যুরা সেই সুযোগে লুটপাট করিয়া
                অরণ্যে-পর্বতে অন্তর্ধান করিল।
                        যুদ্ধ-অন্তে রাজকুমারীকে আর দেখা গেল না। তিনি ভয়ে শিবির হইতে বাহির
                হইয়া পড়িয়াছিলেন এবং একদল পলায়নপর লোককে স্বপক্ষ মনে করিয়া তাহাদের সহিত
                মিশিয়া গিয়াছিলেন।
                        তাহারা অন্য বিবাহের দল। গোলেমালে তাহাদের বধূকে দস্যুরা হরণ করিয়া লইয়া