নৌকাডুবি

কমলা। রাজার নাম কী আগে বলো।

কমলা সকল কথা স্পষ্ট করিয়া লইতে চায়, তাহার কাছে কিছুই উহ্য রাখিলে চলিবে না। রমেশ এতটা জানিলে আগে হইতে আরো বেশি প্রস্তুত হইয়া থাকিত; এখন দেখিল, কমলার গল্প শুনিতে যতই আগ্রহ থাক্‌, গল্পের কোনো জায়গায় তাহার ফাঁকি সহ্য হয় না।

রমেশ হঠাৎ প্রশ্নে একটু থমকিয়া বলিল, “রাজার নাম রণজিৎ সিং।”

কমলা একবার আবৃত্তি করিয়া লইল, “রণজিৎ সিং, মদ্রদেশের রাজা। তার পরে?”

রমেশ। তার পরে একদিন রাজা ভাটের মুখে শুনিলেন, তাঁহারই জাতের আর-এক রাজার এক পরমাসুন্দরী কন্যা আছে।

কমলা। সে আবার কোথাকার রাজা?

রমেশ। মনে করো, সে কাঞ্চীর রাজা।

কমলা। মনে করিব কী! তবে সত্য কি সে কাঞ্চীর রাজা নয়?

রমেশ। কাঞ্চীরই রাজা বটে। তুমি তার নাম জানিতে চাও? তার নাম অমর সিং।

কমলা। সেই মেয়ের নাম তো বলিলে না?— সেই পরমাসুন্দরী কন্যা!

রমেশ। হাঁ হাঁ, ভুল হইয়াছে বটে। সেই মেয়ের নাম— তাহার নাম— ওঃ, তাহার নাম চন্দ্রা—

কমলা। আশ্চর্য! তুমি এমন ভুলিয়া যাও! তুমি তো আমারই নাম ভুলিয়াছিলে।

রমেশ। কোশলের রাজা ভাটের মুখে এই কথা শুনিয়া—

কমলা। কোশলের রাজা কোথা হইতে আসিল? তুমি যে বলিলে মদ্রদেশের রাজা—

রমেশ। সে কি এক জায়গার রাজা ছিল মনে কর? সে কোশলেরও রাজা, মদ্রেরও রাজা।

কমলা। দুই রাজ্য বুঝি পাশাপাশি?

রমেশ। একেবারে গায়ে গায়ে লাগাও।

এইরূপে বারংবার ভুল করিতে করিতে ও সতর্ক কমলার প্রশ্নের সাহায্যে সেইসকল ভুল কোনোমতে সংশোধন করিতে করিতে রমেশ এইরূপ ভাবে গল্পটি বলিয়া গেল—
                        মদ্ররাজ রণজিৎ সিং কাঞ্চীরাজের নিকট রাজকন্যাকে বিবাহ করিবার প্রস্তাব
                জানাইয়া দূত পাঠাইয়া দিলেন। কাঞ্চীর রাজা অমর সিং খুশি হইয়া সম্মত হইলেন।
                        তখন রণজিৎ সিংহের ছোটো ভাই ইন্দ্রজিৎ সিং সৈন্যসামন্ত লইয়া নিশান উড়াইয়া
                কাড়া-নাকাড়া দুন্দুভি-দামামা বাজাইয়া কাঞ্চীর রাজোদ্যানে গিয়া তাঁবু ফেলিলেন।
                কাঞ্চীনগরে উৎসবের সমারোহ পড়িয়া গেল।
                        রাজার দৈবজ্ঞ গণনা করিয়া শুভ দিনক্ষণ স্থির করিয়া দিল। কৃষ্ণা দ্বাদশীতিথিতে
                রাত্রি আড়াই প্রহরের পর লগ্ন। রাত্রে নগরের ঘরে ঘরে ফুলের মালা দুলিল এবং দীপাবলী
                জ্বলিয়া উঠিল। আজ রাত্রে রাজকুমারী চন্দ্রার বিবাহ।
                        কিন্তু কাহার সহিত বিবাহ রাজকন্যা চন্দ্রা সে কথা জানেন না। তাঁহার জন্মকালে
                পরমহংস পরমানন্দস্বামী রাজাকে বলিয়াছিলেন, ‘তোমার এই কন্যার প্রতি অশুভগ্রহের দৃষ্টি
                আছে, বিবাহকালে পাত্রের নাম যেন এ কন্যা জানিতে না পারে।’