ফাল্গুনী

ভয় নেই মহারাজ, বাসাটা একেবারে ভাঙতে হবে না। শ্রুতিভূষণ খবর পেয়েই স্থির করেছেন কবিশেখরের ঐ বাসাটা আজ থেকে তিনিই দখল করবেন।

কী বিপদ। সরস্বতী যে তা হলে তাঁর বীণাখানা আমার মাথার উপর আছড়ে ভেঙে ফেলবেন। না, না, সে হবে না।

আর-একটা কাজ ছিল— শ্রুতিভূষণকে কাঞ্চনপুরের সেই বৃহৎ জনপদটা—

ওহো, সেই জনপদটার দানপত্র তৈরি হয়েছে বুঝি? সেটা কিন্তু আমাদের এই কবিশেখরকে —

সে কী কথা মহারাজ। আমার পুরস্কার তো জনপদ নয় — আমরা জনপদের সেবা তো কখনো করি নি — তাই ঐ পদপ্রাপ্তিটা আশাও করি নে।

আচ্ছা, তবে ওটা শ্রুতিভূষণের জন্যই থাক্‌।

আর, মহারাজ, দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজাদের বিদায় করবার জন্যে সৈন্যদলকে আহ্বান করেছি।

মন্ত্রী, আজ দেখছি পদে পদে তোমার বুদ্ধির বিভ্রাট ঘটছে। দুর্ভিক্ষকাতর প্রজাদের বিদায় করবার ভালো উপায় অন্ন দিয়ে, সৈন্য দিয়ে নয়।

মহারাজ!

কী প্রতিহারী।

বৈরাগ্যবারিধি নিয়ে শ্রুতিভূষণ এসেছেন।

সর্বনাশ করলে! ফেরাও তাকে ফেরাও। মন্ত্রী, দেখো হঠাৎ যেন শ্রুতিভূষণ না এসে পড়ে। আমার দুর্বল মন, হয়তো সামলাতে পারব না, হয়তো অন্যমনস্ক হয়ে বৈরাগ্যবারিধির ডুব-জলে গিয়ে পড়ব। ওহে কবিশেখর, আমাকে কিছুমাত্র সময় দিয়ো না — প্রাণটাকে জাগিয়ে রাখো — একটা যা-হয়-কিছু করো — যেমন এই ফাল্গুনের হাওয়াটা যা-খুশি-তাই করছে তেমনিতরো। হাতে কিছু তৈরি আছে হে? একটা নাটক, কিংবা প্রকরণ, কিংবা রূপক, কিংবা ভান, কিংবা —

তৈরি আছে — কিন্তু সেটা নাটক, কি প্রকরণ, কি রূপক, কি ভান তা ঠিক বলতে পারব না।

যা রচনা করেছ তার অর্থ কি কিছু গ্রহণ করতে পারব।

না মহারাজ। রচনা তো অর্থগ্রহণ করবার জন্যে নয়।

তবে?

সেই রচনাকেই গ্রহণ করবার জন্যে। আমি তো বলেছি আমার এ-সব জিনিস বাঁশির মতো, বোঝবার জন্যে নয়, বাজবার জন্যে।

বল কী হে কবি, এর মধ্যে তত্ত্বকথা কিছুই নেই?

কিচ্ছু না।

তবে তোমার ও-রচনাটা বলছে কী।

ও বলছে, আমি আছি। শিশু জন্মাবামাত্র চেঁচিয়ে ওঠে, সেই কান্নার মানে জানেন মহারাজ? শিশু হঠাৎ শুনতে পায় জল-স্থল-আকাশ তাকে চার দিক থেকে বলে উঠেছে— ” আমি আছি। ”— তারই উত্তরে ঐ প্রাণটুকু সাড়া পেয়ে বলে ওঠে— “আমি আছি। ” আমার রচনা সেই সদ্যোজাত শিশুর কান্না, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ডাকের উত্তরে প্রাণের সাড়া।

তার বেশি আর কিচ্ছু না?

কিচ্ছু না। আমার রচনার মধ্যে প্রাণ বলে উঠেছে, সুখে দুঃখে, কাজে বিশ্রামে, জন্মে মৃত্যুতে, জয়ে পরাজয়ে, লোকে