গোরা
আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন নীচের ঘরে সুচরিতা ললিতা ও আনন্দময়ী রান্নাবান্নার আয়োজনে বসিয়া গেছেন। উপরের ঘরে বানান-সমেত ইংরাজি শব্দ ও তাহার বাংলা প্রতিশব্দ মুখস্থ করার উপলক্ষে সতীশের কণ্ঠস্বরে সমস্ত পাড়া সচকিত হইয়া উঠিয়াছে। বাড়িতে তাহার গলার এত জোর অনুভব করা যাইত না, কিন্তু এখানে সে যে তাহার পড়াশুনায় কিছুমাত্র অবহেলা করিতেছে না ইহাই নিঃসংশয়ে প্রমাণ করিবার জন্য তাহাকে অনেকটা উদ্যম তাহার কণ্ঠস্বরে অনাবশ্যক প্রয়োগ করিতে হইতেছে।

হরিমোহিনীকে আনন্দময়ী বিশেষ সমাদরের সহিত অভ্যর্থনা করিলেন। সে-সমস্ত শিষ্টাচারের প্রতি মনোযোগ না করিয়া তিনি একেবারেই কহিলেন, “আমি রাধারানীকে নিতে এসেছি।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “তা, বেশ তো, নিয়ে যাবে, একটু বোসো।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “না, আমার পূজা-আর্চা সমস্তই পড়ে রয়েছে, আমার আহ্নিক সারা হয় নি— আমি এখন এখানে বসতে পারব না।”

সুচরিতা কোনো কথা না কহিয়া অলাবুচ্ছেদনে নিযুক্ত ছিল। হরিমোহিনী তাহাকেই সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “শুনছ। বেলা হয়ে গেল।”

ললিতা এবং আনন্দময়ী নীরবে বসিয়া রহিল। সুচরিতা তাহার কাজ রাখিয়া উঠিয়া পড়িল এবং কহিল, “মাসি, এসো।”

হরিমোহিনী পাল্‌‍কির অভিমুখে যাইবার উপক্রম করিতে সুচরিতা তাঁহার হাত ধরিয়া কহিল, “এসো, একবার এ ঘরে এসো।”

ঘরের মধ্যে লইয়া গিয়া সুচরিতা দৃঢ়স্বরে কহিল, “তুমি যখন আমাকে নিতে এসেছ তখন সকল লোকের সামনেই তোমাকে অমনি ফিরিয়ে দেব না, আমি তোমার সঙ্গেই যাচ্ছি, কিন্তু আজ দুপুরবেলাই আমি এখানে আবার ফিরে আসব।”

হরিমোহিনী বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “এ আবার কেমন কথা। তা হলে বলো-না কেন, এইখানেই চিরকাল থাকবে।”

সুচরিতা কহিল, “চিরকাল তো থাকতে পাব না। সেইজন্যই যতদিন ওঁর কাছে থাকতে পাই, আমি ওঁকে ছাড়ব না।”

এই কথায় হরিমোহিনীর গা জ্বলিয়া গেল, কিন্তু এখন কোনো কথা বলা তিনি সুযুক্তি বলিয়া বোধ করিলেন না।

সুচরিতা আনন্দময়ীর কাছে আসিয়া হাস্যমুখে কহিল, “মা, আমি তবে একবার বাড়ি হয়ে আসি।”

আনন্দময়ী কোনো প্রশ্ন না করিয়া কহিলেন, “তা, এসো মা!”

সুচরিতা ললিতার কানে কানে কহিল, “আজ আবার দুপুরবেলা আমি আসব।”

পাল্‌‍কির সামনে দাঁড়াইয়া সুচরিতা কহিল, “সতীশ?”

হরিমোহিনী কহিলেন, “সতীশ থাক্‌-না।”

সতীশ বাড়ি গেলে বিঘ্নস্বরূপ হইয়া উঠিতে পারে এই মনে করিয়া সতীশের দূরে অবস্থানই তিনি সুযোগ বলিয়া গণ্য করিলেন।

দুইজনে পাল্‌‍কিতে চড়িলে পর হরিমোহিনী ভূমিকা ফাঁদিবার চেষ্টা করিলেন। কহিলেন, “ললিতার তো বিয়ে হয়ে গেল। তা বেশ হল, একটি মেয়ের জন্যে তো পরেশবাবু নিশ্চিন্ত হলেন!”

এই বলিয়া, ঘরের মধ্যে অবিবাহিত মেয়ে যে কতবড়ো একটা দায়, অভিভাবক-গণের পক্ষে যে কিরূপ দুঃসহ উৎকণ্ঠার কারণ, তাহা প্রকাশ করিলেন।

“কী বলব তোমাকে, আমার আর অন্য ভাবনা নেই। ভগবানের নাম করতে করতে ঐ চিন্তাই মনে এসে পড়ে। সত্য বলছি, ঠাকুর-সেবায় আমি আগেকার মতো তেমন মন দিতেই পারি নে। আমি বলি, গোপীবল্লভ, সব কেড়েকুড়ে নিয়ে এ আবার আমাকে কী নূতন ফাঁদে জড়ালে!”

হরিমোহিনীর এ যে কেবলমাত্র সাংসারিক উৎকণ্ঠা তাহা নহে, ইহাতে তাঁহার মুক্তিপথের বিঘ্ন হইতেছে। তবু এতবড়ো গুরুতর