গোরা
আপনা-আপনি বলিতে লাগিল— মা, মা, মা! বলিতে বলিতে তাহার হৃদয় স্ফীত হইয়া উঠিয়া দুই চক্ষু দিয়া অশ্রু ঝরিতে লাগিল। এমন সময় হঠাৎ দেখিল, আনন্দময়ী তাহার মশারি উদ্‌ঘাটন করিয়া বিছানার মধ্যে প্রবেশ করিলেন। তিনি তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া কহিলেন, “আমাকে ডাকছিলে কি?”

তখন সুচরিতার চেতনা হইল, সে ‘মা মা’ বলিতেছিল। সুচরিতা কোনো উত্তর করিতে পারিল না, আনন্দময়ীর কোলে মুখ চাপিয়া কাঁদিতে লাগিল। আনন্দময়ী কোনো কথা না বলিয়া ধীরে ধীরে তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন। সে রাত্রে তিনি তাহার কাছেই শয়ন করিলেন।

বিনয়ের বিবাহ হইয়া যাইতেই তখনই আনন্দময়ী বিদায় লইতে পারিলেন না। তিনি বলিলেন, ‘ইহারা দুইজনেই আনাড়ি, ইহাদের ঘরকন্না একটুখানি গুছাইয়া না দিয়া আমি যাই কেমন করিয়া?’

সুচরিতা কহিল, “মা, তবে এ ক’দিন আমিও তোমার সঙ্গে থাকব।”

ললিতাও উৎসাহিত হইয়া কহিল, “হাঁ মা, সুচিদিদিও আমাদের সঙ্গে কিছুদিন থাক্‌।”

সতীশ এই পরামর্শ শুনিতে পাইয়া ছুটিয়া আসিয়া সুচরিতার গলা ধরিয়া লাফাইতে লাফাইতে কহিল, “হাঁ দিদি, আমিও তোমাদের সঙ্গে থাকব।”

সুচরিতা কহিল, “তোমার যে পড়া আছে বক্তিয়ার!”

সতীশ কহিল, “বিনয়বাবু আমাকে পড়াবেন।”

সুচরিতা কহিল, “বিনয়বাবু এখন তোর মাস্টারি করতে পারবেন না।”

বিনয় পাশের ঘর হইতে বলিয়া উঠিল, “খুব পারব। একদিনে এমনি কি অশক্ত হয়ে পড়েছি তা তো বুঝতে পারছি নে। অনেক রাত জেগে লেখাপড়া যেটুকু শিখেছিলুম তাও যে এক রাত্রে সমস্ত ভুলে বসে আছি এমন তো বোধ হয় না।”

আনন্দময়ী সুচরিতাকে কহিলেন, “তোমার মাসি কি রাজি হবেন?”

সুচরিতা কহিল, “আমি তাঁকে একটা চিঠি লিখছি।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “তুমি লিখো না। আমিই লিখব।”

আনন্দময়ী জানিতেন সুচরিতা যদি থাকিতে ইচ্ছা করে তবে হরিমোহিনীর তাহাতে অভিমান হইবে। কিন্তু তিনি অনুরোধ জানাইলে রাগ যদি করেন তবে তাঁহার উপরেই করিবেন, তাহাতে ক্ষতি নাই।

আনন্দময়ী পত্রে জানাইলেন, ললিতার নূতন ঘরকন্না ঠিকঠাক করিয়া দিবার জন্য কিছুকাল তাঁহাকে বিনয়ের বাড়িতে থাকিতে হইবে। সুচরিতাও যদি এ কয়দিন তাঁহার সঙ্গে থাকিতে অনুমতি পায় তবে তাঁহার বিশেষ সহায়তা হয়।

আনন্দময়ীর পত্রে হরিমোহিনী কেবল যে ক্রুদ্ধ হইলেন তাহা নহে, তাঁহার মনে বিশেষ একটা সন্দেহ উপস্থিত হইল। তিনি ভাবিলেন, ছেলেকে তিনি বাড়ি আসিতে বাধা দিয়াছেন, এবার সুচরিতাকে ফাঁদে ফেলিবার জন্য মা কৌশলজাল বিস্তার করিতেছে। তিনি স্পষ্টই দেখিতে পাইলেন ইহাতে মাতাপুত্রের পরামর্শ আছে। আনন্দময়ীর ভাবগতিক দেখিয়া গোড়াতেই যে তাঁহার ভালো লাগে নাই সে কথাও তিনি স্মরণ করিলেন।

আর কিছুমাত্র বিলম্ব না করিয়া যত শীঘ্র সম্ভব সুচরিতাকে একবার বিখ্যাত রায়গোষ্ঠীর অন্তর্গত করিয়া নিরাপদ করিয়া তুলিতে পারিলে তিনি বাঁচেন। কৈলাসকেই বা এমন করিয়া কতদিন বসাইয়া রাখা যায়! সে বেচারা যে অহোরাত্র তামাক টানিয়া টানিয়া বাড়ির দেয়ালগুলা কালি করিবার জো করিল।

যেদিন চিঠি পাইলেন, হরিমোহিনী তাহার পরদিন সকালেই পাল্‌‍কিতে করিয়া বেহারাকে সঙ্গে লইয়া স্বয়ং বিনয়ের বাসায়