গোরা
৬৯

গোরা আজকাল সকালেই বাড়ি হইতে বাহির হইয়া যায়, বিনয় তাহা জানিত, এইজন্য অন্ধকার থাকিতেই সোমবার দিন প্রত্যুষে সে তাহার বাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইল; একেবারে উপরে উঠিয়া তাহার শয়নগৃহে গেল। সেখানে গোরাকে দেখিতে না পাইয়া চাকরের কাছে সন্ধান লইয়া জানিল, সে ঠাকুরঘরে আছে। ইহাতে সে মনে মনে কিছু আশ্চর্য হইল। ঠাকুরঘরের দ্বারের কাছে আসিয়া দেখিল, গোরা পূজার ভাবে বসিয়া আছে; একটি গরদের ধুতি পরা, গায়ে একটি গরদের চাদর, কিন্তু তাহার বিপুল শুভ্রদেহের অধিকাংশই অনাবৃত। বিনয় গোরাকে পূজা করিতে দেখিয়া আরো আশ্চর্য হইয়া গেল।

জুতার শব্দ পাইয়া গোরা পিছন ফিরিয়া দেখিল; বিনয়কে দেখিয়া গোরা উঠিয়া পড়িল এবং ব্যস্ত হইয়া কহিল, “এ ঘরে এসো না।”

বিনয় কহিল, “ভয় নেই, আমি যাব না। তোমার কাছেই আমি এসেছিলুম।”

গোরা তখন বাহির হইয়া কাপড় ছাড়িয়া তেতলার ঘরে বিনয়কে লইয়া বসিল।

বিনয় কহিল, “ভাই গোরা, আজ সোমবার।”

গোরা কহিল, “নিশ্চয়ই সোমবার— পাঁজির ভুল হতেও পারে, কিন্তু আজকের দিন সম্বন্ধে তোমার ভুল হবে না। অন্তত আজ মঙ্গলবার নয়, সেটা ঠিক।”

বিনয় কহিল, “তুমি হয়তো যাবে না, জানি— কিন্তু আজকের দিনে তোমাকে একবার না বলে এ কাজে আমি প্রবৃত্ত হতে পারব না। তাই আজ ভোরে উঠেই প্রথম তোমার কাছে এসেছি।”

গোরা কোনো কথা না বলিয়া স্থির হইয়া বসিয়া রহিল।

বিনয় কহিল, “তা হলে আমার বিবাহের সভায় যেতে পারবে না এ কথা নিশ্চয় স্থির?”

গোরা কহিল, “না বিনয়, আমি যেতে পারব না।”

বিনয় চুপ করিয়া রহিল। গোরা হৃদয়ের বেদনা সম্পূর্ণ গোপন করিয়া হাসিয়া কহিল, “আমি নাইবা গেলুম, তাতে কী? তোমারই তো জিত হয়েছে। তুমি তো মাকে টেনে নিয়ে গেছ। এত চেষ্টা করলুম, তাঁকে তো কিছুতে ধরে রাখতে পারলুম না। শেষে আমার মাকে নিয়েও তোমার কাছে আমার হার মানতে হল। বিনয়, একে একে ‘সব লাল হো জায়গা’ নাকি! আমার মানচিত্রটাতে কেবল আমিই একলা এসে ঠেকব!”

বিনয় কহিল, “ভাই, আমাকে দোষ দিয়ো না কিন্তু। আমি তাঁকে খুব জোর করেই বলেছিলুম, ‘মা, আমার বিয়েতে তুমি কিছুতেই যেতে পাবে না।’ মা বললেন, ‘দেখ্‌ বিনু, তোর বিয়েতে যারা যাবে না তারা তোর নিমন্ত্রণ পেলেও যাবে না, আর যারা যাবে তাদের তুই মানা করলেও যাবে— সেইজন্যেই তোকে বলি, তুই কাউকে নিমন্ত্রণও করিস নে, মানাও করিস নে, চুপ করে থাক্‌।’ গোরা, তুমি কি আমার কাছে হার মেনেছ? তোমার মা’র কাছে তোমার হার— সহস্রবার হার। অমন মা কি আর আছে!”

গোরা যদিচ আনন্দময়ীকে বদ্ধ করিবার জন্য সম্পূর্ণ চেষ্টা করিয়াছিল, তথাপি তিনি যে তাহার কোনো বাধা না মানিয়া, তাহার ক্রোধ ও কষ্টকে গণ্য না করিয়া বিনয়ের বিবাহে চলিয়া গেলেন, ইহাতে গোরা তাহার অন্তরতর হৃদয়ের মধ্যে বেদনা বোধ করে নাই, বরঞ্চ একটা আনন্দ লাভ করিয়াছিল। বিনয় তাহার মাতার অপরিমেয় স্নেহের যে অংশ পাইয়াছিল, গোরার সহিত বিনয়ের যতবড়ো বিচ্ছেদই হউক, সেই গভীর স্নেহসুধার অংশ হইতে তাহাকে কিছুতেই বঞ্চিত করিতে পারিবে না ইহা নিশ্চয় জানিয়া গোরার মনের ভিতরে একটা যেন তৃপ্তি ও শান্তি জন্মিল। আর-সব দিকেই বিনয়ের কাছ হইতে সে বহু দূরে যাইতে পারে,