গোরা

হরিমোহিনী কহিলেন, “বেশ তো, ভুল যদি বুঝে থাকি তুমি ভালো করে বুঝিয়েই বলো-না।”

সুচরিতা দৃঢ়বলে সমস্ত সংকোচ অধঃকৃত করিয়া কহিল, “আচ্ছা, তবে বলি। আমি আমার গুরুর কাছ থেকে এমন একটি কথা পেয়েছি যা আমার কাছে নতুন, সেটিকে সম্পূর্ণ গ্রহণ করতে খুব শক্তির দরকার, আমি তারই অভাব বোধ করছি— আপনার সঙ্গে কেবলই লড়াই করে পেরে উঠছি নে। কিন্তু, মাসি, তুমি আমাদের সম্বন্ধকে বিকৃত করে দেখেছ, তুমি তাঁকে অপমানিত করে বিদায় করে দিয়েছ, তুমি তাঁকে যা বলেছ সমস্ত ভুল, তুমি আমাকে যা ভাবছ সমস্ত মিথ্যা— তুমি অন্যায় করেছ। তাঁর মতো লোককে নিচু করতে পার তোমার এমন সাধ্য নেই, কিন্তু কেন তুমি আমার উপরে এমন অত্যাচার করলে, আমি তোমার কী করেছি?”

বলিতে বলিতে সুচরিতার স্বর রুদ্ধ হইয়া গেল, সে অন্য ঘরে চলিয়া গেল।

হরিমোহিনী হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন। তিনি মনে মনে কহিলেন, ‘না বাপু, এমন সব কথা আমি সাত জন্মে শুনি নাই।’

সুচরিতাকে কিছু শান্ত হইতে সময় দিয়া কিছুক্ষণ পরে তাহাকে আহারে ডাকিয়া লইয়া গেলেন। সে খাইতে বসিলে তাহাকে বলিলেন, “দেখো রাধারানী, আমার তো বয়স নিতান্ত কম হয় নি। হিন্দুধর্মে যা বলে তা তো শিশুকাল থেকে করে আসছি, আর শুনেওছি বিস্তর। তুমি এ-সব কিছুই জান না, সেইজন্যেই গৌরমোহন তোমার গুরু হয়ে তোমাকে কেবল ভোলাচ্ছে। আমি তো ওর কথা কিছু-কিছু শুনেছি— ওর মধ্যে আদত কথা কিছুই নেই, ও শাস্ত্র ওঁর নিজের তৈরি, এ-সব আমাদের কাছে ধরা পড়ে, আমরা গুরু-উপদেশ পেয়েছি। আমি তোমাকে বলছি রাধারানী, তোমাকে এ-সব কিছুই করতে হবে না, যখন সময় হবে আমার যিনি গুরু আছেন— তিনি তো এমন ফাঁকি নন— তিনিই তোমাকে মন্ত্র দেবেন। তোমার কোনো ভয় নেই, আমি তোমাকে হিন্দুসমাজে ঢুকিয়ে দেব। ব্রাহ্মঘরে ছিলে, নাহয় ছিলে। কেই বা সে খবর জানবে! তোমার বয়স কিছু বেশি হয়েছে বটে, তা এমন বাড়ন্ত মেয়ে ঢের আছে। কেই বা তোমার কুষ্ঠি দেখছে! আর টাকা যখন আছে তখন কিছুতেই কিছু বাধবে না, সবই চলে যাবে। কৈবর্তের ছেলে কায়স্থ বলে চলে গেল, সে তো আমি নিজের চক্ষে দেখেছি। আমি হিন্দুসমাজে এমন সদ্‌ব্রাহ্মণের ঘরে তোমাকে চালিয়ে দেব, কারো সাধ্য থাকবে না কথা বলে— তারাই হল সমাজের কর্তা। এজন্যে তোমাকে এত গুরুর সাধ্যসাধনা, এত কান্নাকাটি করে মরতে হবে না।”

এই-সকল কথা হরিমোহিনী যখন বিস্তারিত করিয়া ফলাইয়া ফলাইয়া বলিতেছিলেন, সুচরিতার তখন আহারে রুচি চলিয়া গিয়াছিল, তাহার গলা দিয়া যেন গ্রাস গলিতেছিল না। কিন্তু সে নীরবে অত্যন্ত জোর করিয়াই খাইল; কারণ, সে জানিত তাহার কম খাওয়া লইয়াই এমন আলোচনার সৃষ্টি হইবে যাহা তাহার পক্ষে কিছুমাত্র উপাদেয় হইবে না।

হরিমোহিনী যখন সুচরিতার কাছে বিশেষ কোনো সাড়া পাইলেন না তখন তিনি মনে মনে কহিলেন, ‘গড় করি, ইহাদিগকে গড় করি।’ এ দিকে হিন্দু হিন্দু করিয়া কাঁদিয়া কাটিয়া অস্থির, ও দিকে এতোবড়ো একটা সুযোগের কথায় কর্ণপাত নাই। প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে না, কোনো কৈফিয়তটি দিতে হইবে না, কেবল এ দিকে ও দিকে অল্পসল্প কিছু টাকা খরচ করিয়া অনায়াসেই সমাজে চলিয়া যাইবে— ইহাতেও যাহার উৎসাহ হয় না সে আপনাকে বলে কিনা হিন্দু! গোরা যে কতবড়ো ফাঁকি হরিমোহিনীর তাহা বুঝিতে বাকি রহিল না। অথচ এমনতরো বিড়ম্বনার উদ্দেশ্য কী হইতে পারে তাহা চিন্তা করিতে গিয়া সুচরিতার অর্থই সমস্ত অনর্থের মূল বলিয়া তাঁহার মনে হইল, এবং সুচরিতার রূপযৌবন। যত শীঘ্র কোম্পানির কাগজাদি-সহ কন্যাটিকে উদ্ধার করিয়া তাঁহার শ্বাশুরিক দুর্গে আবদ্ধ করিতে পারেন ততই মঙ্গল। কিন্তু মন আর-একটু নরম না হইলে চলিবে না। সেই নরম হইবার প্রত্যাশায় তিনি দিনরাত্রি সুচরিতার কাছে তাঁহার শ্বশুরবাড়ির ব্যাখ্যা করিতে লাগিলেন। তাহাদের ক্ষমতা কিরূপ অসামান্য, সমাজে তাহারা কিরূপ অসাধ্যসাধন করিতে পারে, নানা দৃষ্টান্তসহ তাহার বর্ণনা করিতে লাগিলেন। তাহাদের প্রতিকূলতা করিতে গিয়া কত