গোরা
নিষ্কলঙ্ক লোক সমাজে নিগ্রহ ভোগ করিয়াছে এবং তাহাদের শরণাপন্ন হইয়া কত লোক মুসলমানের রান্না মুর্গি খাইয়াও হিন্দুসমাজের অতি দুর্গম পথ হাস্যমুখে উত্তীর্ণ হইয়াছে, নামধাম-বিবরণ-দ্বারা তিনি সে-সকল ঘটনাকে বিশ্বাসযোগ্য করিয়া তুলিলেন।

সুচরিতা তাহাদের বাড়িতে যাতায়াত না করে বরদাসুন্দরীর এ ইচ্ছা গোপন ছিল না; কারণ, নিজের স্পষ্ট ব্যবহার সম্বন্ধে তাঁহার একটা অভিমান ছিল। অন্যের প্রতি অসংকোচে কঠোরাচরণ করিবার সময় তিনি নিজের এই গুণটি প্রায়ই ঘোষণা করিতেন। অতএব বরদাসুন্দরীর ঘরে সুচরিতা যে কোনোপ্রকার সমাদর প্রত্যাশা করিতে পারিবে না ইহা সহজবোধ্য ভাষাতেই তাহার নিকট ব্যক্ত হইয়াছে। সুচরিতা ইহাও জানিত যে, সে তাঁহাদের বাড়িতে যাওয়া-আসা করিলে পরেশকে ঘরের মধ্যে অত্যন্ত অশান্তি ভোগ করিতে হইত। এইজন্য সে নিতান্ত প্রয়োজন না হইলে, ও বাড়িতে যাইত না এবং এইজন্যই পরেশ প্রত্যহ একবার বা দুইবার স্বয়ং সুচরিতার বাড়িতে আসিয়া তাহার সঙ্গে দেখা করিয়া যাইতেন।

কয়দিন পরেশবাবু নানা চিন্তা ও কাজের তাড়ায় সুচরিতার ওখানে আসিতে পারেন নাই। এই কয়দিন সুচরিতা প্রত্যহ ব্যগ্রতার সহিত পরেশের আগমন প্রত্যাশাও করিয়াছে, অথচ তাহার মনের মধ্যে একটা সংকোচ এবং কষ্টও হইয়াছে। পরেশের সঙ্গে তাহার গভীরতর মঙ্গলের সম্বন্ধ কোনোকালেই ছিন্ন হইতে পারে না তাহা সে নিশ্চয় জানে, কিন্তু বাহিরের দুই-একটা বড়ো বড়ো সূত্রে যে টান পড়িয়াছে ইহার বেদনাও তাহাকে বিশ্রাম দিতেছে না। এ দিকে হরিমোহিনী তাহার জীবনকে অহরহ অসহ্য করিয়া তুলিয়াছেন। এইজন্য সুচরিতা আজ বরদাসুন্দরীর অপ্রসন্নতাও স্বীকার করিয়া পরেশের বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইল। অপরাহ্নশেষের সূর্য তখন পার্শ্ববর্তী পশ্চিম দিকের তেতালা বাড়ির আড়ালে পড়িয়া সুদীর্ঘ ছায়া বিস্তার করিয়াছে; এবং সেই ছায়ায় পরেশ তখন শির নত করিয়া একলা তাঁহার বাগানের পথে ধীরে ধীরে পদচারণা করিতেছিলেন।

সুচরিতা তাঁহার পাশে আসিয়া যোগ দিল! কহিল, “বাবা, তুমি কেমন আছ?”

পরেশবাবু হঠাৎ তাঁহার চিন্তায় বাধা পাইয়া ক্ষণকালের জন্য স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রাধারানীর মুখের দিকে চাহিলেন এবং কহিলেন, “ভালো আছি রাধে!”

দুইজনে বেড়াইতে লাগিলেন। পরেশবাবু কহিলেন, “সোমবারে ললিতার বিবাহ।”

সুচরিতা ভাবিতেছিল, এই বিবাহে তাহাকে কোনো পরামর্শে বা সহায়তায় ডাকা হয় নাই কেন এ কথা সে জিজ্ঞাসা করিবে। কিন্তু কুণ্ঠিত হইয়া উঠিতেছিল, কেননা তাহার তরফেও এবার এক জায়গায় একটা কী বাধা আসিয়া পড়িয়াছিল। আগে হইলে সে তো ডাকিবার অপেক্ষা রাখিত না।

সুচরিতার মনে এই-যে একটি চিন্তা চলিতেছিল পরেশ ঠিক সেই কথাটাই আপনি তুলিলেন; কহিলেন, “তোমাকে এবার ডাকতে পারি নি রাধে!”

সুচরিতা জিজ্ঞাসা করিল, “কেন বাবা?”

সুচরিতার এই প্রশ্নে পরেশ কোনো উত্তর না দিয়া তাহার মুখের দিকে নিরীক্ষণ করিয়া রহিলেন। সুচরিতা আর থাকিতে পারিল না। সে মুখ একটু নত করিয়া কহিল, “তুমি ভাবছিলে, আমার মনের মধ্যে একটা পরিবর্তন ঘটেছে।”

পরেশ কহিলেন, “হাঁ, তাই ভাবছিলুম আমি তোমাকে কোনোরকম অনুরোধ করে সংকোচে ফেলব না।”

সুচরিতা কহিল, “বাবা, আমি তোমাকে সব কথা বলব মনে করেছিলুম, কিন্তু তোমার যে দেখা পাই নি। সেইজন্যেই আজ আমি এসেছি। আমি যে তোমাকে বেশ ভালো করে আমার মনের ভাব বলতে পারব আমার সে ক্ষমতা নেই। আমার ভয় হয় পাছে ঠিকটি তোমার কাছে বলা না হয়।”