প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
সুচরিতা তাড়াতাড়ি ললিতার মুখে হাত চাপা দিয়া কহিল, “ললিতা, তোর পায়ে পড়ি ভাই, ও কথা মুখে আনিস নে! ও কথা শুনলে আমার মাটিতে মিশিয়ে যেতে ইচ্ছা করে।”
ললিতা কহিল, “কেন ভাই, তিনি কি— ”
সুচরিতা ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিল, “না না না! পাগলের মতো কথা বলিস নে ললিতা! যে কথা মনে করা যায় না সে কথা মুখে আনতে নেই।”
ললিতা সুচরিতার এই সংকোচে বিরক্ত হইয়া কহিল, “এ কিন্তু, ভাই, তোমার বাড়াবাড়ি। আমি খুব লক্ষ্য করে দেখেছি আর আমি তোমাকে নিশ্চয় বলতে পারি— ”
সুচরিতা ললিতার হাত ছাড়াইয়া লইয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। ললিতা তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিয়া গিয়া তাহাকে ধরিয়া আনিয়া কহিল, “আচ্ছা, আচ্ছা, আর আমি বলব না।”
সুচরিতা কহিল,“কোনোদিন না!”
ললিতা কহিল, “অতবড়ো প্রতিজ্ঞা করতে পারব না। যদি আমার দিন আসে তো বলব, নইলে নয়, এইটুকু কথা দিলুম।”
এ কয়দিন হরিমোহিনী ক্রমাগতই সুচরিতাকে চোখে চোখে রাখিতেছিলেন, তাহার কাছে কাছে ফিরিতেছিলেন, সুচরিতা তাহা বুঝিতে পারিয়াছিল এবং হরিমোহিনীর এই সন্দেহপূর্ণ সতর্কতা তাহার মনের উপর একটা বোঝার মতো চাপিয়া ছিল। ইহাতে ভিতরে ভিতরে সে ছট্ফট্ করিতেছিল, অথচ কোনো কথা বলিতে পারিতেছিল না। আজ ললিতা চলিয়া গেলে অত্যন্ত ক্লান্ত মন লইয়া সুচরিতা টেবিলের উপরে দুই হাতের মধ্যে মাথা রাখিয়া কাঁদিতেছিল। বেহারা ঘরে আলো দিতে আসিয়াছিল, তাহাকে নিষেধ করিয়া দিয়াছে। তখন হরিমোহিনীর সায়ংসন্ধ্যার সময়। তিনি উপর হইতে ললিতাকে চলিয়া যাইতে দেখিয়া অসময়ে নামিয়া আসিলেন এবং সুচরিতার ঘরে প্রবেশ করিয়াই ডাকিলেন, “রাধারানী!”
সুচরিতা গোপনে চোখ মুছিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইল।
হরিমোহিনী কহিলেন, “কী হচ্ছে?”
সুচরিতা তাহার কোনো উত্তর করিল না। হরিমোহিনী কঠোর স্বরে কহিলেন, “এ-সমস্ত কী হচ্ছে আমি তো কিছু বুঝতে পারছি নে।”
সুচরিতা কহিল, “মাসি, কেন তুমি দিনরাত্রি আমার উপরে এমন করে দৃষ্টি রেখেছ?”
হরিমোহিনী কহিলেন, “কেন রেখেছি তা কি বুঝতে পার না? এই-যে খাওয়া-দাওয়া নেই, কান্নাকাটি চলছে, এ-সব কী লক্ষণ? আমি তো শিশু না, আমি কি এইটুকু বুঝতে পারি নে?”
সুচরিতা কহিল, “মাসি, আমি তোমাকে বলছি তুমি কিছুই বোঝ নি। তুমি এমন ভয়ানক অন্যায় ভুল বুঝছ যে, সে প্রতি মুহূর্তে আমার পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠছে।”