বাঁশরি

ক্ষিতিশ। আমাদের দুজনের মধ্যে কে বেশি ভয়ংকর, বিচার করবেন বিধাতাপুরুষ।

অর্চনা। না, ঠাট্টা করবেন না। সিঙাড়াটা শেষ করে ফেলুন। আপনি ওস্তাদ, ঠাট্টায় আপনার সঙ্গে পারব না। মোস্ট ইণ্টারেস্টিং আপনার বইখানা। এমন-সব মানুষ কোত্থাও দেখা যায় না। ঐ-যে মেয়েটা কী তার নাম-কথায় কথায় হাঁপিয়ে উঠে বলে, মাই আইজ্‌, ও গড–লাজুক ছেলে স্যাণ্ডেলের সংকোচ ভাঙবার জন্যে নিজে মোটর হাঁকিয়ে ইচ্ছে করে গাড়িটা ফেললে খাদে, মতলব ছিল স্যাণ্ডেলকে দুই হাতে তুলে পতিতোদ্ধার করবে। হবি তো হ স্যাণ্ডেলের হাতে হল কম্পউণ্ড ফ্র্যাক্‌চার। কী ড্রামাটিক, রিয়ালিজ্‌মের চূড়ান্ত! ভালোবাসার এতবড়ো আধুনিক পদ্ধতি বেদব্যাসের জানা ছিল না। ভেবে দেখুন, সুভদ্রার কত বড়ো চান্স্‌ মারা গেল, আর অর্জুনেরও কজ্বি গেল বেঁচে।

ক্ষিতিশ। কম মডার‌্ন্ নন আপনি। আমার মতো নির্লজ্জকেও লজ্জা দিতে পারেন।

অর্চনা। দোহাই ক্ষিতিশবাবু, বিনয় করবেন না। আপনি নির্লজ্জ! লজ্জা গলা দিয়ে সন্দেশ গলছে না। কলমটার কথা স্বতন্ত্র।

লীলা। (কিছু দূর থেকে) অর্চনামাসি,সময় হয়ে এল, ডাক পড়েছে।

অর্চনা। (জনান্তিকে) লীলা, আধমরা করেছি, বাকিটুকু তোর হাতে।

[ অর্চনার প্রস্থান

লীলা সাহিত্যে ফাস্ট্র্‌ ক্লাস এম. এ. ডিগ্রি নিয়ে আবার সায়েন্স ধরেছে। রোগা শরীর, ঠাট্টা-তামাশায় তীক্ষ্ণ, সাজগোজে নিপুণ, কটাক্ষে দেখবার অভ্যাস।

লীলা। ক্ষিতিশবাবু, নমস্কার! আপনি ‘সর্বত্র পূজ্যতে’র দলে। লুকোবেন কোথায়, পূজারী আপনাকে খুঁজে বের করে নিজের গরজে। এনেছি অটোগ্রাফের খাতা। সুযোগ কি কম। কী লিখলেন দেখি।
‘অন্য-সকলের মতো নয় যে-মানুষ তার মার অন্য-সকলের হাতে।’চমৎকার, কিন্তু প্যাথেটিক। মারে ঈর্ষা করে। মনে রাখবেন, ছোটো যারা তাদের ভক্তিরই একটা ইডিয়ম ঈর্ষা, মারটা তাদের পূজা।

ক্ষিতিশ। বাগ্‌বাদিনীর জাতই বটে, কথায় আশ্চর্য করে দিলেন।

লীলা। বাচস্পতির জাত যে আপনারা। যেটা বললেম ওটা কোটেশন। পুরুষের লেখা থেকেই। আপনাদের প্রতিভা বাক্যরচনায়, আমাদের নৈপণ্যু বাক্য-প্রয়োগে। ওরিজিন্যালিটি আপনার বইয়ের পাতায় পাতায়। সেদিন আপনারই লেখা গল্পের বই পড়লেম। ব্রীলিয়েণ্ট্‌। ঐ-যে যাতে একজন মেয়ের কথা আছে, সে যখন দেখলে স্বামীর মন আর-এক জনের উপরে, বানিয়ে চিঠি লিখলে; স্বামীর কাছে প্রমাণ করে দিলে যে সে ভালোবাসে তাদের প্রতিবেশী বামনদাসকে। আশ্চর্য সাইকলজির ধাঁধা। বোঝা শক্ত, স্বামীর মনে ঈর্ষা জাগাবার এই ফন্দী, না তাকে নিষ্কৃতি দেবার ঔদার্য।

ক্ষিতিশ। না না, আপনি ওটা-

লীলা। বিনয় করবেন না। এমন ওরিজিন্যাল আইডিয়া, এমন ঝক্‌ঝকে ভাষা, এমন চরিত্রচিত্র আপনার আর-কোনো লেখায় দেখি নি। আপনার নিজের রচনাকেও বহু দূরে ছাড়িয়ে গেছেন। ওতে আপনার মুদ্রাদোষগুলো নেই, অথচ-

ক্ষিতিশ। ভুল করছেন আপনি। ‘রক্তজবা’ –ও-বইটা যতীন ঘটকের।

লীলা। বলেন কী! ছি, ছি, এমন ভুলও হয়! যতীন ঘটককে যে আপনি রোজ দু-বেলা গাল দিয়ে থাকেন। আমার এ কী বুদ্ধি! মাপ করবেন আমার অজ্ঞানকৃত অপরাধ। আপনার জন্যে আর-এক পেয়ালা চা পাঠিয়ে দিচ্ছি –রাগ করে ফিরিয়ে দেবেন না।

[ লীলার প্রস্থান