প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
লীলা। সম্পূর্ণ। বাঁশি আমার দিকে ফিরে বললে, ‘তুই তো এম. এস্সি.-তে বায়োকেমিস্ট্রি নিয়েছিস, শুনলি তো? বিশ্বে রমণীর রমণীয়তা যে অংশে সেইটিকে কেটে ছিঁড়ে পুড়িয়ে গুঁড়িয়ে হাইড্রলিক প্রেস দিয়ে দলিয়ে সল্ফ্যুরিক অ্যাসিড দিয়ে গলিয়ে তোকে রিসর্চে লাগতে হবে।’ দেখো একবার দুষ্টুমি, আমি কোনোকালে বায়োকেমিস্ট্রি নিই নি। ওর পোষা জীবকে নাচাবার জন্যে চাতুরী। তাই বলছি, ভয় নেই, মেয়েরা যাকে গাল দেয় তাকেও বিয়ে করতে পারে কিন্তু যাকে বিদ্রূপ করে তাকে নৈব নৈব চ। সব-শেষে বোকাটা বললে, ‘আজ স্পষ্ট বুঝলুম, পুরুষ তেমনি করেই নারীকে চায় যেমন করে মরুভূমি চায় জলকে,মাটির তলার বোবা ভাষাকে উদ্ভিদ করে তোলবার জন্যে।’ এত হেসেছি!
তারক। তুমি তো ঐ বললে। আমি একদিন ক্ষিতীশের তালি-দেওয়া মুখ নিয়ে একটু ঠাট্টার আভাস দিয়েছিলেম। বাঁশরি বলে উঠলেন, ‘দেখো লাহিড়ি, ওর মুখ দেখতে আমার পজিটিভ্লি ভালো লাগে।’ আমি আশ্চর্য হয়ে বললেম, ‘তা হলে মুখখানা বিশুদ্ধ মডার্ন্ আর্ট। বুঝতে ধাঁধা লাগে।’ ওর সঙ্গে কথায় কে পারবে–ও বললে, ‘বিধাতার তুলিতে অসীম সাহস। যাকে ভালো দেখতে করতে চান তাকে সুন্দর দেখতে করা দরকার বোধ করেন না। তাঁর মিষ্টান্ন ছড়ান ইতর লোকদেরই পাতে।’ বাই জোভ্, সূক্ষ্ম বটে।
শৈল। আর কি কোনো কথা নেই তোমাদের। ক্ষিতিশবাবু শুনতে পাবেন যে।
সতীশ। ভয় নেই, ওখানে ফোয়ারা ছুটছে, বাতাস উলটো দিকে, শোনা যাবে না।
অর্চনা। আচ্ছা, তোমরা সব তাস খেলো, টেনিস খেলতে যাও, ওই মানুষটার সঙ্গে হিসেব চুকিয়ে আসি গে।
অর্চনা প্লেটে খাবার সাজিয়ে নিয়ে গেল ক্ষিতীশের কাছে। দোহারা গড়নের দেহ, সাজে-সজ্জায় কিছু অযত্ন আছে, হাসিখুশি ঢল্ঢলে মুখ, আয়ু পশ্চিমের দিকে এক ডিগ্রি হেলেছে।
অর্চনা। ক্ষিতিশবাবু, পালিয়ে বসে আছেন আমাদের কাছ থেকে তার মানে বুঝতে পারি, কিন্তু খাবার টেবিলটাকে অস্পৃশ্য করলেন কোন্ দোষে। নিরাকার আইডিয়ায় আপনারা অভ্যস্ত, নিরাহার ভোজেও কি তাই। আমরা বঙ্গনারী বঙ্গসাহিত্যের সেবার ভার পেয়েছি যে দিকটাতে সে দিকে আপনাদের পাকযন্ত্র।
ক্ষিতিশ। দেবী, আমরা জোগাই রসাত্মক বাক্য, তা নিয়ে তর্ক ওঠে; আপনারা দেন রসাত্মক বস্তু, ওটা অন্তরে গ্রহণ করতে মতান্তর ঘটে না।
অর্চনা। কী চমৎকার! আমি যখন থালায় কেক সন্দেশ গোছাচ্ছিলুম আপনি ততক্ষণ কথাটা বানিয়ে নিচ্ছিলেন। সাত জন্ম উপোষ করে থাকলেও আমার মুখ দিয়ে এমন ঝক্ঝকে কথাটা বেরত না। তা যাক গে; পরিচয় নেই, তবু এলুম কাছে, কিছু মনে করবেন না। পরিচয় দেবার মতো নেই বিশেষ কিছু। বালিগঞ্জ থেকে টালিগঞ্জে যাবার ভ্রমণবৃত্তান্তও কোনো মাসিকপত্রে আজ পর্যন্ত ছাপাই নি। আমার নাম অর্চনা সেন। ঐ-যে অপরিচিত ছোটো মেয়েটি বেণী দুলিয়ে বেড়াচ্ছে, আমি তারই অখ্যাত কাকী।
ক্ষিতিশ। এবার তা হলে আমার পরিচয়টা –
অর্চনা। বলেন কী! পাড়াগেঁয়ে ঠাওরালেন আমাকে? শেয়ালদ-স্টেশনে কি গাইড রাখতে হয় চেঁচিয়ে জানাতে যে কলকাতা শহরটা রাজধানী। এই পরশুদিন পড়েছি আপনার ‘বেমানান’গল্পটা। পড়ে হেসে মরি আর-কি। ও কী! প্রশংসা শুনতে আজও আপনার লজ্জা বোধ হয়! খাওয়া বন্ধ করলেন যে? আচ্ছা, সত্যি বলুন, নিশ্চয় ঘরের লোক কাউকে লক্ষ্য করে লিখেছেন। রক্তের যোগ না থাকলে অমন অদ্ভুত সৃষ্টি বানানো যায় না। ঐ-যে, যে জায়গাটাতে মিস্টার কিষেণ গাপ্টা বি. এ. ক্যাণ্টাব, মিস্ লোটিকার পিঠের দিকের জামার ফাঁক দিয়ে আঙটি ফেলে দিয়ে খানাতল্লাশির দাবি করে হো-হো বাধিয়ে দিলে। আমার বন্ধুরা সবাই পড়ে বললে, ম্যাচ্লেস–বঙ্গসাহিত্যে এ জায়গাটার দেশলাই মেলে না, একটু পোড়াকাঠিও না। আপনার লেখা ভয়ানক রিয়লিস্টিক ক্ষিতিশবাবু। ভয় হয় আপনার সামনে দাঁড়াতে।