প্রজাপতির নির্বন্ধ
আপনার আদর্শের উপযুক্ত করতে পারি।”

একান্ত নিষ্ঠার সহিত উচ্চারিত এই কথাগুলি শুনিয়া চন্দ্রবাবু কিছু বিস্মিত হইলেন। তাঁহার সকল উপদেশের প্রতি নির্মলার তর্কবিহীন বিনম্র শ্রদ্ধার কথা মনে পড়িল। স্নেহার্দ্র মনে আবার ভাবিলেন, এ যেন নির্মলারই ভাই।

চন্দ্র। আমার ভাগ্নী নির্মলাকে কুমারসভার সভ্যশ্রেণীতে ভুক্ত করতে আপনাদের কোনো আপত্তি নেই?

রসিক। আর কোনো আপত্তি নেই, কেবল একটু ব্যাকরণের আপত্তি। কুমারসভায় কেউ যদি কুমারীবেশে আসেন তা হলে বোপদেবের অভিশাপ।

শৈল। বোপদেবের অভিশাপ একালে খাটে না।

রসিক। আচ্ছা, অন্তত লোহারামকে তো বাঁচিয়ে চলতে হবে। আমি তো বোধ করি, স্ত্রীসভ্যরা যদি পুরুষসভ্যদের অজ্ঞাতসারে বেশ ও নাম পরিবর্তন করে আসেন তা হলে সহজে নিষ্পত্তি হয়।

শ্রীশ। তা হলে একটা কৌতুক এই হয় যে, কে স্ত্রী কে পুরুষ নিজেদের এই সন্দেহটা থেকে যায়–

বিপিন। আমি বোধ হয় সন্দেহ থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারি।

রসিক। আমাকেও বোধ হয় আমার নাতনী বলে কারো হঠাৎ আশঙ্কা না হতে পারে।

শ্রীশ। কিন্তু অবলাকান্তবাবু সম্বন্ধে একটা সন্দেহ থেকে যায়।

তখন শৈল অদূরবর্তী টিপাই হইতে মিষ্টান্নের থালা আনিতে প্রস্থান করিল।

চন্দ্র। দেখুন রসিকবাবু, ভাষাতত্ত্বে দেখা যায়, ব্যবহার করতে করতে একটা শব্দের মূল অর্থ লোপ পেয়ে বিপরীত অর্থ ঘটে থাকে। স্ত্রীসভ্য গ্রহণ করলে চিরকুমার-সভার অর্থের যদি পরিবর্তন ঘটে তাতে ক্ষতি কী?

রসিক। কিছু না। আমি পরিবর্তনের বিরোধী নই– তা নাম-পরিবর্তন বা বেশ-পরিবর্তন বা অর্থ-পরিবর্তন যাই হোক-না কেন, যখন যা ঘটে আমি বিনা বিরোধে গ্রহণ করি বলেই আমার প্রাণটা নবীন আছে।

মিষ্টান্ন শেষ হইল এবং স্ত্রীসভ্য লওয়া সম্বন্ধে কাহারও আপত্তি হইল না।

আহার-অবসানে রসিক কহিল, “আশা করি সভার কাজের কোনো ব্যাঘাত হয় নি।”

শ্রীশ কহিল, “কিছু না– অন্যদিন কেবল মুখেরই কাজ চলত, আজ দক্ষিণ হস্তও যোগ দিয়েছে।”

বিপিন। তাতে আভ্যন্তরিক তৃপ্তিটা কিছু বেশি হয়েছে।

শুনিয়া শৈল খুশি হইয়া তাহার স্বাভাবিক স্নিগ্ধকোমল হাস্যে সকলকে পুরস্কৃত করিল।

নবম পরিচ্ছেদ

অক্ষয়। হল কী বল দেখি! আমার যে ঘরটি এতকাল কেবল ঝড়ু বেহারার ঝাড়নের তাড়নে নির্মল ছিল, সেই ঘরের হাওয়া দু-বেলা তোমাদের দুই বোনের অঞ্চলবীজনে চঞ্চল হয়ে উঠছে যে!

নীরবালা। দিদি নেই, তুমি একলা পড়ে আছ বলে দয়া করে মাঝে মাঝে দেখা দিয়ে যাই, তার উপরে আবার জবাবদিহি?

অক্ষয়।                                গান। ভৈরবী
                                    ওগো দয়াময়ী চোর, এত দয়া মনে তোর!
                                বড়ো দয়া করে কণ্ঠে আমার জড়াও মায়ার ডোর!