প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
পথে আসিতে আসিতে দুই বন্ধুর মধ্যে কোনো কথাই হয় নাই। এখানে আসিয়া ঘরে প্রবেশ না করিতেই যে শব্দগুলি শোনা গেল, অন্য কোনো দিন হইলে শ্রীশ তাহা লক্ষ্য করিত কি না সন্দেহ– আজ তাহার কাছে কিছুই এড়াইল না। অনতিপূর্বেই ঘরের মধ্যে রমণীদল যে ছিল, ঘরে প্রবেশ করিয়াই সে তাহা বুঝিতে পারিল।
অক্ষয় চলিয়া গেলে ঘরটি শ্রীশ ভালো করিয়া দেখিয়া লইল। টেবিলের মাঝখানে ফুলদানিতে ফুল সাজানো। সেটা চকিতে তাহাকে একটু যেন বিচলিত করিল। তাহার একটা কারণ শ্রীশ অত্যন্ত ফুল ভালোবাসে, তাহার আর-একটা কারণ শ্রীশ কল্পনাচক্ষে দেখিতে পাইল– অনতিকাল পূর্বেই যাহাদের সুনিপুণ দক্ষিণ হস্ত এই ফুলগুলি সাজাইয়াছে তাহারাই এখনই ত্রস্তপদে ঘর হইতে পলাইয়া গেল।
বিপিন ঈষৎ হাসিয়া বলিল, “যা বল ভাই, এ ঘরটি চিরকুমার-সভার উপযুক্ত নয়।”
হঠাৎ মৌনভঙ্গে শ্রীশ চকিত হইয়া উঠিয়া কহিল, “কেন নয়?”
বিপিন কহিল, “ঘরের সজ্জাগুলি তোমার নবীন সন্ন্যাসীদের পক্ষেও যেন বেশি বোধ হচ্ছে।”
শ্রীশ। আমার সন্ন্যাসধর্মের পক্ষে বেশি কিছুই হতে পারে না।
বিপিন। কেবল নারী ছাড়া!
শ্রীশ কহিল, “হাঁ, ঐ একটি মাত্র!”– লেখকের অনুমানমাত্র হইতে পারে, কিন্তু অন্যদিনের মতো কথাটায় তেমন জোর পৌঁছিল না।
বিপিন কহিল, “দেয়ালের ছবি এবং অন্যান্য পাঁচরকমে এ ঘরটিতে সেই নারীজাতির অনেকগুলি পরিচয় পাওয়া যায় যেন।”
শ্রীশ। সংসারে নারীজাতির পরিচয় তো সর্বত্রই আছে।
বিপিন। তা তো বটেই। কবিদের কথা যদি বিশ্বাস করা যায় তা হলে চাঁদে ফুলে লতায় পাতায় কোনোখানেই নারীজাতির পরিচয় থেকে হতভাগ্য পুরুষমানুষের নিষ্কৃতি পাবার জো নেই।
শ্রীশ হাসিয়া কহিল, “কেবল ভেবেছিলুম, চন্দ্রবাবুর বাসার সেই একতলার ঘরটিতে রমণীর কোনো সংস্রব ছিল না। আজ সে ভ্রমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। নাঃ, ওরা পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছে।”
বিপিন। বেচারা চিরকুমার কটির জন্যে একটা কোণও ফাঁকা রাখে নি। সভা করবার জায়গা পাওয়াই দায়।
শ্রীশ “এই দেখো-না” বলিয়া কোণের একটা টিপাই হইতে গোটাদুয়েক চুলের কাঁটা তুলিয়া দেখাইল।
বিপিন কাঁটা দুটি লইয়া পর্যবেক্ষণ করিয়া কহিল, “ওহে ভাই, এ স্থানটা তো কুমারদের পক্ষে নিষ্কণ্টক নয়।”
শ্রীশ। ফুলও আছে, কাঁটাও আছে।
বিপিন। সেইটেই তো বিপদ। কেবল কাঁটা থাকলে এড়িয়ে চলা যায়।
শ্রীশ অপর কোণের ছোটো বইয়ের শেল্ফ হইতে বইগুলি তুলিয়া দেখিতে লাগিল। কতকগুলি নভেল, কতকগুলি ইংরাজি কাব্যসংগ্রহ। প্যাল্গ্রেভের গীতিকাব্যের স্বর্ণভাণ্ডার খুলিয়া দেখিল, মার্জিনে মেয়েলি অক্ষরে নোট লেখা– তখন গোড়ার পাতাটা উল্টাইয়া দেখিল। দেখিয়া একটু নাড়িয়া চাড়িয়া বিপিনের সম্মুখে ধরিল।
বিপিন পড়িয়া কহিল, “নৃপবালা! আমার বিশ্বাস নামটি পুরুষমানুষের নয়। কী বোধ কর।”
শ্রীশ। আমারও সেই বিশ্বাস। এ নামটিও অন্যজাতীয়ের বলে ঠেকছে হে!
বলিয়া আর-একটা বই দেখাইল।