প্রজাপতির নির্বন্ধ

চাকর আসিয়া খবর দিল, পূর্ণবাবু আসিয়াছেন। নির্মলা ঘর হইতে চলিয়া গেলে তিনি প্রবেশ করিলেন। কহিলেন, “চন্দ্রবাবু, সে কথাটা কি ভেবে দেখলেন? আমাদের সভাটিকে স্থানান্তর করা আমার বিবেচনায় ভালো হচ্ছে না।”

চন্দ্র। আজ আর-একটি কথা উঠেছে, সেটা পূর্ণবাবু, তোমার সঙ্গে ভালো করে আলোচনা করতে ইচ্ছা করি। আমার একটি ভাগ্নী আছেন বোধ হয় জানো?

পূর্ণ। (নিরীহভাবে) আপনার ভাগ্নী?

চন্দ্র। হাঁ, তাঁর নাম নির্মলা। আমাদের চিরকুমার-সভার সঙ্গে তাঁর হৃদয়ের খুব যোগ আছে।

পূর্ণ। (বিস্মিতভাবে) বলেন কী!

চন্দ্র। আমার বিশ্বাস, তাঁর অনুরাগ এবং উৎসাহ আমাদের কারো চেয়ে কম নয়।

পূর্ণ। (উত্তেজিতভাবে) এ কথা শুনলে আমাদের উৎসাহ বেড়ে ওঠে। স্ত্রীলোক হয়ে তিনি–

চন্দ্র। আমিও সেই কথা ভাবছি, স্ত্রীলোকের সরল উৎসাহ পুরুষের উৎসাহে যেন নূতন প্রাণ সঞ্চার করতে পারে– আমি নিজেই সেটা আজ অনুভব করেছি।

পূর্ণ। (আবেগপূর্ণভাবে) আমিও সেটা বেশ অনুমান করতে পারি।

চন্দ্র। পূর্ণবাবু, তোমারও কি ঐ মত?

পূর্ণ। কী মত বলছেন?

চন্দ্র। অর্থাৎ, যথার্থ অনুরাগী স্ত্রীলোক আমাদের কঠিন কর্তব্যের বাধা না হয়ে যথার্থ সহায় হতে পারেন?

পূর্ণ। (নেপথ্যের প্রতি লক্ষ করিয়া উচ্চকণ্ঠে) সে বিষয়ে আমার লেশমাত্র সন্দেহ নেই, স্ত্রীজাতির অনুরাগ পুরুষের অনুরাগের একমাত্র সজীব নির্ভর– পুরুষের উৎসাহকে নবজাত শিশুটির মতো মানুষ করে তুলতে পারে কেবল স্ত্রীলোকের উৎসাহ।

শ্রীশ ও বিপিনের প্রবেশ

শ্রীশ। তা তো পারে পূর্ণবাবু, কিন্তু সেই উৎসাহের অভাবেই কি আজ সভায় যেতে বিলম্ব হচ্ছে?

পূর্ণ এত উচ্চস্বরে বলিয়া উঠিয়াছিল যে নবাগত দুইজনে সিঁড়ি হইতেই সকল কথা শুনিতে পাইয়াছিলেন।

চন্দ্রবাবু কহিলেন, “না, না, দেরি হবার কারণ, আমার গলার বোতামটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি নে।”

শ্রীশ। গলায় তো একটা বোতাম লাগানো রয়েছে দেখতে পাচ্ছি– আরো কি প্রয়োজন আছে? যদি-বা থাকে, আর ছিদ্র পাবেন কোথা?

চন্দ্রবাবু গলায় হাত দিয়া বলিলেন, “তাই তো!” বলিয়া ঈষৎ লজ্জিত হইয়া হাসিতে লাগিলেন।

চন্দ্র। আমরা সকলেই তো উপস্থিত আছি, এখন সেই কথাটার আলোচনা হয়ে যাওয়া ভালো, কী বল পূর্ণবাবু?

হঠাৎ পূর্ণবাবুর উৎসাহ অনেকটা নামিয়া গেল। নির্মলার নাম করিয়া সকলের কাছে আলোচনা উত্থাপন তাহার কাছে রুচিকর বোধ হইল না। সে কিছু কুণ্ঠিতস্বরে কহিল, “সে বেশ কথা, কিন্তু এ দিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে না?”

চন্দ্র। না, এখনো সময় আছে। শ্রীশবাবু, তোমরা একটু বোসো-না, কথাটা একটু স্থির হয়ে ভেবে দেখবার যোগ্য। আমার একটি ভাগ্নী আছেন, তাঁর নাম নির্মলা–

পূর্ণ হঠাৎ কাশিয়া লাল হইয়া উঠিল। ভাবিল চন্দ্রবাবুর কাণ্ডজ্ঞানমাত্রই নাই– পৃথিবীর লোকের কাছে নিজের ভাগ্নীর পরিচয় দিবার কী দরকার– অনায়াসে নির্মলাকে বাদ দিয়া কথাটা আলোচনা করা যাইতে পারে। কিন্তু কোনো কথার কোনো অংশ বাদ