প্রজাপতির নির্বন্ধ
পরীক্ষা করিতে হয় তেমনি করিয়া নির্মলার মুখখানি দুই আঙুল দিয়া তুলিয়া ধরিয়া ক্ষণকাল দেখিলেন এবং গম্ভীর মৃদু হাস্যে কহিলেন, “নির্মল আকাশে একটুখানি মালিন্য দেখছি যেন! কী হয়েছে বলো দেখি।”

নির্মলা জানিত চন্দ্রমাধববাবু অনুমানের চেষ্টাও করিবেন না। যাহা স্পষ্ট প্রকাশমান নহে তাহা তিনি মনের মধ্যে স্থানও দিতেন না। তাঁহার নিজের চিত্ত যেমন শেষ পর্যন্ত স্বচ্ছ অন্যের নিকটও সেইরূপ একান্ত স্বচ্ছতা প্রত্যাশা করিতেন।

নির্মলা ক্ষুব্ধ স্বরে কহিল, “এত দিন পরে আমাকে তোমাদের চিরকুমার-সভা থেকে বিদায় দিচ্ছ কেন? আমি কী করেছি?”

চন্দ্রমাধববাবু আশ্চর্য হইয়া কহিলেন,“চিরকুমার-সভা থেকে তোমাকে বিদায়? তোমার সঙ্গে সে সভার যোগ কী?”

নির্মলা। দরজার আড়ালে থাকলে বুঝি যোগ থাকে না? অন্তত সেই যতটুকু যোগ তাই বা কেন যাবে?

চন্দ্রবাবু। নির্মল, তুমি তো এ সভার কাজ করবে না– যারা কাজ করবে তাদের সুবিধার প্রতি লক্ষ রেখেই–

নির্মলা। আমি কেন কাজ করব না? তোমার ভাগ্নে না হয়ে ভাগ্নী হয়ে জন্মেছি বলেই কি তোমাদের হিতকার্যে যোগ দিতে পারব না? তবে আমাকে এত দিন শিক্ষা দিলে কেন? নিজের হাতে আমার সমস্ত মনপ্রাণ জাগিয়ে দিয়ে শেষকালে কাজের পথ রোধ করে দাও কী বলে?

চন্দ্রমাধববাবু এই উচ্ছ্বাসের জন্য কিছুমাত্র প্রস্তুত ছিলেন না; তিনি যে নির্মলাকে নিজে কী ভাবে গড়িয়া তুলিয়াছিলেন তাহা নিজেই জানিতেন না। ধীরে ধীরে কহিলেন, “নির্মল, এক সময়ে তো বিবাহ করে তোমাকে সংসারের কাজে প্রবৃত্ত হতে হবে– চিরকুমার-সভার কাজ– ”

“বিবাহ আমি করব না।”

“তবে কী করবে বলো।”

“দেশের কাজে তোমার সাহায্য করব।”

“আমরা তো সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়েছি।”

“ভারতবর্ষে কি কেউ কখনো সন্ন্যাসিনী হয় নি?”

চন্দ্রমাধববাবু স্তম্ভিত হইয়া হারানো বোতামটার কথা একেবারে ভুলিয়া গেলেন। নিরুত্তর হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।

উৎসাহদীপ্তিতে মুখ আরক্তিম করিয়া নির্মলা কহিল, “মামা, যদি কোনো মেয়ে তোমাদের ব্রত গ্রহণের জন্যে অন্তরের সঙ্গে প্রস্তুত হয় তবে প্রকাশ্যভাবে তোমাদের সভার মধ্যে কেন তাকে গ্রহণ করবে না? আমি তোমাদের কৌমার্যসভার কেন সভ্য না হব?”

নিষ্কলুষচিত্ত চন্দ্রমাধবের কাছে ইহার কোনো উত্তর ছিল না। তবু দ্বিধাকুণ্ঠিতভাবে বলিতে লাগিলেন, “অন্য যাঁরা সভ্য আছেন– ”

নির্মলা কথা শেষ না হইতেই বলিয়া উঠিল, “যাঁরা সভ্য আছেন, যাঁরা ভারতবর্ষের হিতব্রত নেবেন, যাঁরা সন্ন্যাসী হতে যাচ্ছেন– তাঁরা কি একজন ব্রতধারিণী স্ত্রীলোককে অসংকোচে নিজের দলে গ্রহণ করতে পারবেন না? তা যদি হয় তা হলে তাঁরা গৃহী হয়ে ঘরে রুদ্ধ থাকুন, তাঁদের দ্বারা কোনো কাজ হবে না।”

চন্দ্রমাধববাবু চুলগুলার মধ্যে ঘন ঘন পাঁচ আঙুল চালাইয়া অত্যন্ত উস্কোখুস্কো করিয়া তুলিলেন। এমন সময় হঠাৎ তাঁহার আস্তিনের ভিতর হইতে হারানো বোতামটা মাটিতে পড়িয়া গেল; নির্মলা হাসিতে হাসিতে কুড়াইয়া লইয়া চন্দ্রমাধববাবুর কামিজের গলায় লাগাইয়া দিল– চন্দ্রমাধববাবু তাহার কোনো খবর লইলেন না-চুলের মধ্যে অঙ্গুলি চালনা করিতে করিতে মস্তিষ্ককুলায়ের চিন্তাগুলিকে বিব্রত করিতে লাগিলেন।