প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
কুমু বলে উঠল, “না, সে কিছুতেই হবে না। তুমি কেবল বলে দাও কোন্ দিক দিয়ে যেতে হবে।”
মোতির মা অন্তঃপুরের ঝরকা-দেওয়া বারান্দা দিয়ে ঘরটা দেখিয়ে দিলে। কুমু বেরিয়ে এল। ভৃত্যেরা সচকিত হয়ে উঠে তাকে প্রণাম করলে। কুমু ঘরে ঢুকে ডেস্কের দেরাজ খুলে দেখলে তার চিঠি। তুলে নিয়ে দেখলে লেফাফা খোলা। বুকের ভিতরটা ফুলে উঠতে লাগল, একেবারে অসহ্য হয়ে উঠল। যে বাড়িতে কুমু মানুষ হয়েছে সেখানে এ-রকম অবমাননা কোনোমতেই কল্পনা পর্যন্ত করা যেত না। নিজের আবেগের এই তীব্র প্রবলতাতেই তাকে ধাক্কা মেরে সচেতন করে তুলল। সে বলে উঠল, ‘প্রিয়ঃ প্রিয়ায়ার্হসি দেব সোঢ়ুম্’—তবু তুফান থামে না— তাই বার বার বললে। বাইরে যে আরদালি ছিল, আপিসঘরে তাদের বউরানীর এই আপন-মনে মন্ত্র-আবৃত্তি শুনে সে অবাক হয়ে গেল। অনেকক্ষণ বলতে বলতে কুমুর মন শান্ত হয়ে এল। তখন চিঠিখানি সামনে রেখে চৌকিতে বসে হাত জোড় করে স্থির হয়ে রইল। চিঠি সে চুরি করে পড়বে না এই তার পণ।
এমন সময়ে মধুসূদন ঘরে ঢুকেই চমকে উঠে দাঁড়াল— কুমু তার দিকে চাইলেও না। কাছে এসে দেখলে, ডেস্কের উপর সেই চিঠি। জিজ্ঞাসা করলে, “তুমি এখানে যে!”
কুমু নীরবে শান্ত দৃষ্টিতে মধুসূদনের মুখের দিকে চাইলে। তার মধ্যে নালিশ ছিল না। মধুসূদন আবার জিজ্ঞাসা করলে, “এ ঘরে তুমি কেন?”
এই বাহুল্যপ্রশ্নে কুমু অধৈর্যের স্বরেই বললে, “আমার নামে দাদার চিঠি এসেছে কি না তাই দেখতে এসেছিলেম।”
সে কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করলে না কেন, এমনতরো প্রশ্নের রাস্তা কাল রাত্তিরে মধুসূদন আপনি বন্ধ করে দিয়েছে। তাই বললে, “এ চিঠি আমিই তোমার কাছে নিয়ে যাচ্ছিলুম, সেজন্যে তোমার এখানে আসবার তো দরকার ছিল না।”
কুমু একটুখানি চুপ করে রইল, মনকে শান্ত করে তার পরে বললে, “এ চিঠি তুমি আমাকে পড়তে দিতে ইচ্ছে কর নি, সেইজন্যে এ চিঠি আমি পড়ব না। এই আমি ছিঁড়ে ফেললুম। কিন্তু এমন কষ্ট আমাকে আর কখনো দিয়ো না। এর চেয়ে কষ্ট আমার আর কিছু হতে পারে না।”
এই বলে সে মুখে কাপড় দিয়ে ছুটে বেরিয়ে চলে গেল।
ইতিপূর্বে আজ মধ্যাহ্নে আহারের পর মধুসূদনের মনটা আলোড়িত হয়ে উঠছিল। আন্দোলন কিছুতে থামাতে পারছিল না। কুমুর খাওয়া হলেই তাকে ডাকিয়ে পাঠাবে বলে ঠিক করে রেখেছে। আজ সে মাথার চুল আঁচড়ানো সম্বন্ধে একটু বিশেষ যত্ন নিলে। আজ সকালেই একটি ইংরেজ নাপিতের দোকান থেকে স্পিরিট-মেশানো সুগন্ধি কেশতৈল ও দামী এসেন্স কিনিয়ে আনিয়েছিল। জীবনে এই প্রথম সেগুলি সে ব্যবহার করেছে। সুগন্ধি ও সুসজ্জিত হয়ে সে প্রস্তুত ছিল। আপিসের সময় আজ অন্তত পঁয়তাল্লিশ মিনিট পেরিয়ে গেল।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেতেই মধুসূদন চমকে উঠে বসল। হাতের কাছে আর-কিছু না পেয়ে একখানা পুরোনো খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের পাতাটা নিয়ে এমন ভাবে সেটাকে দেখতে লাগল যেন তার আপিসেরই কাজের অঙ্গ। এমন-কি, পকেট থেকে একটা মোটা নীল পেন্সিল বের করে দুটো-একটা দাগও টেনে দিলে।
এমন সময়ে ঘরে প্রবেশ করলে শ্যামাসুন্দরী। ভ্রূকুঞ্চিত করে মধুসূদন তার মুখের দিকে চাইলে। শ্যামাসুন্দরী বললে, “তুমি এখানে বসে আছ; বউ যে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।”
“খুঁজে বেড়াচ্ছে! কোথায়?”
“এই যে দেখলুম, বাইরে তোমার আপিসঘরে গিয়ে ঢুকল। তা এতে অত আশ্চর্য হচ্ছ কেন ঠাকুরপো— সে ভেবেছে তুমি বুঝি—”