যোগাযোগ

“কোন্‌টা নিজের কোন্‌টা নিজের নয়, সে বিচার এ বাড়ির কর্তা করে দেন।”

কুমু তার পণ ভুলতে যাচ্ছিল, এমন সময় হঠাৎ মনের ভিতরটা তর্জনী তুলে বলে উঠল, ‘রাগ কোরো না।’ ক্ষণকালের জন্যে কুমু চোখ বুজলে। নিঃশব্দ বাক্যে ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল, ‘প্রিয়ঃ প্রিয়ায়ার্হসি দেব সোঢ়ুম্‌।’

কুমু বললে, “আমার চিঠি কেউ যদি চুরি করেন করুন, আমি তাই বলে চুরি করে চুরির শোধ দিতে চাই নে।”

বলেই কুমুর তখনই মনে হল কথাটা কঠিন হয়েছে। বুঝতে পারলে, ভিতরে যে রাগ আছে নিজের অগোচরে সে আপনাকে প্রকাশ করে। তাকে উন্মূলিত করতে হবে। তার সঙ্গে লড়াই করতে চাইলে সব সময় তো তার নাগাল পাওয়া যায় না। গুহার মধ্যে সে দুর্গ তৈরি করে থাকে, বাইরে থেকে সেখানে প্রবেশের পথ কই? তাই এমন একটি প্রেমের বন্যা নামিয়ে আনা চাই যাতে রুদ্ধকে মুক্ত করে, বদ্ধকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। মনকে ভুলিয়ে দেবার ওর একটি উপায় হাতে ছিল, সে হচ্ছে সংগীত। কিন্তু এ বাড়িতে এসরাজ বাজাতে ওর লজ্জা করে। সঙ্গে এসরাজ আনেও নি। কুমু গান গাইতে পারে, কিন্তু কুমুর গলায় তেমন জোর নেই। গানের ধারায় আকাশ ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছা করল, অভিমানের গান। যে গানে ও বলতে পারে, “আমি তো তোমারই ডাকে এসেছি, তবে তুমি কেন লুকোলে? আমি তো নিমেষের জন্যে দ্বিধা করি নি, তবে আজ আমাকে কেন এমন সংশয়ের মধ্যে ফেললে? “এই-সব কথা খুব গলা ছেড়ে গান গেয়ে ওর বলতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, তা হলেই যেন সুরে এর উত্তর পাবে।


৩৪

কুমুর পালাবার একটিমাত্র জায়গা আছে, এ বাড়ির ছাদ। সেইখানে চলে গেল। বেলা হয়েছে, প্রখর রৌদ্রে ছাদ ভরে গেছে, কেবল প্রাচীরের গায়ে এক জায়গায় একটুখানি ছায়া। সেইখানে গিয়ে বসল। একটি গান মনে পড়ল, তার সুরটি আশাবরী। সে গানের আরম্ভটি হচ্ছে, “বাঁশরী হমারি রে”— কিন্তু বাকিটুকু ওস্তাদের মুখে মুখে বিকৃত বাণী— তার মানে বুঝতে পারা যায় না। কুমু ঐ অসম্পূর্ণ অংশ আপন ইচ্ছামত নূতন নূতন তান দিয়ে ভরিয়ে পালটে পালটে গাইতে লাগল। ঐ একটুখানি কথা অর্থে ভরে উঠল। ঐ বাক্যটি যেন বলছে, ‘ও আমার বাঁশি, তোমাতে সুর ভরে উঠছে না কেন? অন্ধকার পেরিয়ে পৌঁচচ্ছে না কেন যেখানে দুয়ার রুদ্ধ, যেখানে ঘুম ভাঙল না? বাঁশরী হমারি রে, বাঁশরী হমারি রে!’

মোতির মা যখন এসে বললে “চলো ভাই, খেতে যাবে” তখন সেই ছাদের কোণের একটুখানি ছায়া গেছে লুপ্ত হয়ে, কিন্তু তখন ওর মন সুরে ভরপুর, সংসারে কে ওর ’পরে কী অন্যায় করেছে সে সমস্ত তুচ্ছ হয়ে গেছে। ওর চিঠি নিয়ে মধুসূদনের যে ক্ষুদ্রতা, যে ক্ষুদ্রতায় ওর মনে তীব্র অবজ্ঞা উদ্যত হয়ে উঠেছিল, সে যেন এই রোদভরা আকাশে একটা পতঙ্গের মতো কোথায় বিলীন হয়ে গেল, তার ক্রুদ্ধ গুঞ্জন মিলিয়ে গেল অসীম আকাশে। কিন্তু চিঠির মধ্যে দাদার যে স্নেহবাক্য আছে সেটুকু পাবার জন্যে তার মনের আগ্রহ তো যায় না।

ঐ ব্যগ্রতাটা তার মনে লেগে রইল। খাওয়া হয়ে গেলে আর সে থাকতে পারলে না। মোতির মাকে বললে, “আমি যাই বাইরের ঘরে, চিঠি পড়ে আসি।”

মোতির মা বললে, “আর একটু দেরি হোক, চাকররা সবাই যখন ছুটি নিয়ে খেতে যাবে, তখন যেয়ো।”

কুমু বললে, “না, না, সে বড়ো চুরি করে যাওয়ার মতো হবে। আমি সকলের সামনে দিয়ে যেতে চাই, তাতে যে যা মনে করে করুক।”

মোতির মা বললে, “তা হলে চলো আমিও সঙ্গে যাই।”