প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
যেখানে কুমু ব্যক্তিগত মানুষ সেখানে যতই তার মন ধিক্কারে ঘৃণায় বিতৃষ্ণায় ভরে উঠছে, যতই তার সংসার সেখানে আপন গায়ের জোরে রূঢ় অধিকার তাকে অপমানিত করছে ততই সে আপনার চারি দিকে একটা আবরণ তৈরি করছে। এমন একটা আবরণ যাতে করে নিজের কাছে তার ভালো-লাগা মন্দ-লাগার সত্যতাকে লুপ্ত করে, অর্থাৎ নিজের সম্বন্ধে নিজের চৈতন্যকে কমিয়ে দেয়। এ হচ্ছে ক্লোরোফর্মের বিধান। কিন্তু এ তো দু-তিন ঘণ্টার ব্যবস্থা নয়, সমস্ত দিনরাত্রি বেদনাবোধকে বিতৃষ্ণাবোধকে তাড়িয়ে রাখতে হবে। এই অবস্থায় মেয়েরা যদি কোনোমতে একজন গুরুকে পায় তবে তার আত্মবিস্মৃতির চিকিৎসা সহজ হয়; সে তো সম্ভব হল না। তাই মনে মনে পূজার মন্ত্রকে নিয়তই বাজিয়ে রাখতে চেষ্টা করলে। তার এই দিনরাত্রির মন্ত্রটি ছিল—
হে আমার পূজনীয়, তোমার কাছে আমার সমস্ত শরীর প্রণত করে এই প্রসাদটি চাই যে, পিতা যেমন করে পুত্রকে, সখা যেমন করে সখাকে, প্রিয় যেমন করে প্রিয়াকে সহ্য করতে পারেন, হে দেব, তুমিও যেন আমাকে তেমনি করে সইতে পার। তুমি যে তোমার ভালোবাসায় আমাকে সহ্য করতে পার তার প্রমাণ এ ছাড়া আর কিছু নয় যে, তোমার ভালোবাসায় আমিও সমস্ত ক্ষমা করতে পারি। কুমু চোখ বুজে মনে মনে তাঁকে ডেকে বলে, ‘তুমি তো বলেছ, যে মানুষ আমাকে সব জায়গায় দেখে, আমার মধ্যে সমস্তকে দেখে, সেও আমাকে ত্যাগ করে না, আমিও তাকে ত্যাগ করি নে। এই সাধনায় আমার যেন একটুও শৈথিল্য না হয়।’
আজ সকালে স্নান করে চন্দন-গোলা জল দিয়ে তার শরীরকে অনেকক্ষণ ধরে অভিষিক্ত করে নিলে। দেহকে নির্মল করে সুগন্ধি করে সে তাঁকে উৎসর্গ করে দিলে— মনে মনে একাগ্রতার সঙ্গে ধ্যান করতে লাগল যে, নিমেষে নিমেষে তার হাতে তাঁর হাত আছে, তার সমস্ত শরীরে তাঁর সর্বব্যাপী স্পর্শ অবিরাম বিরাজমান। এ দেহকে সত্যরূপে সম্পূর্ণরূপে তিনিই পেয়েছেন, তাঁর পাওয়ার বাইরে যে শরীরটা সে তো মিথ্যা, সে তো মায়া, সে তো মাটি, দেখতে দেখতে মাটিতে মিশিয়ে যাবে। যতক্ষণ তাঁর স্পর্শকে অনুভব করি ততক্ষণ এ দেহ কিছুতেই অপবিত্র হতে পারে না। এই কথা মনে করতে করতে আনন্দে তার চোখের পাতা ভিজে এল— তার দেহটা যেন মুক্তি পেলে মাংসের স্থূল বন্ধন থেকে। পুণ্যসম্মিলনের নিত্যক্ষেত্র বলে আপন দেহের উপর তার যেন ভক্তি এল। যদি কুন্দফুলের মালা হাতের কাছে পেত তা হলে এখনই আজ সে পরত গলায়, বাঁধত কবরীতে। স্নান করে পরল সে একটি শুভ্র শাড়ি, খুব মোটা লাল পাড় দেওয়া। ছাদে যখন বসল তখন মনে হল সূর্যের আলো হয়ে আকাশপূর্ণ একটি পরম স্পর্শ তার দেহকে অভিনন্দিত করলে।
মোতির মা’র কাছে এসে কুমু বললে, “আমাকে তোমার কাজে লাগিয়ে দাও।”
মোতির মা হেসে বললে, “এসো তবে তরকারি কুটবে।”