প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
দার্জিলিঙ-ফেরত নীহারকে হঠাৎ কলেজে দেখে সুরীতিও আশ্চর্য হয়ে গেল—বললে, “আপনি হিমালয় থেকে ফিরলেন কবে।”
নীহার হেসে বললে, “ওগো সীমন্তিনী, কিছু হাওয়া খেয়ে আসা গেল। কালিদাস বলেছেন : মন্দাকিনীনির্ঝরশীকরাণাং বোঢ়া মুহুঃ কম্পিতদেবদারুঃ। ঐ দেবদারুর চেয়ে ঢের বেশি কাঁপিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের রোগা হাড়, এই দেখো-না কম্বল জড়িয়ে ভুটিয়া সেজে এসেছি।”
সুরীতি হেসে বললে, “কেন, সাজ তো মন্দ হয় নি আর আপনার চেহারাও তো দেখাচ্ছে ভালো, ভুটিয়া বকুর সাজসজ্জাতে আপনাকে ভালো মানিয়েছে।”
নীহার বললে, “খুশি হলুম, এখন তো আর শীতের থেকে রক্ষা পাবার কথা ভাবতে হবে না, এখন কী দিয়ে তোমাদের চোখ ভোলাব এইটেই হচ্ছে সমস্যা—সেটা আরো শক্ত কথা।”
সুরীতি। তা চোখ ভোলাবার দরকার কী। পুরুষমানুষের সহায়তা করে তার বিদ্যে তুমি জান তো তোমার মধ্যে তার অভাব নেই।
নীহার। এইটে তোমাদের ভুল। নিউটন বলেছিলেন তিনি জ্ঞানসমুদ্রের নুড়ি কুড়িয়েছেন, আমি তো কেবলমাত্র বালুর কণা সংগ্রহ করেছি।
সুরীতি। বাস্ রে! এবার পাহাড় থেকে দেখছি তুমি অনেকখানি বিনয় সংগ্রহ করে এনেছ, এ তো তোমার কখনো ছিল না।
নীহার। দেখো, এ শিক্ষা আমার স্বয়ং কালিদাসের কাছ থেকে, যিনি বলেছেন : প্রাংশুলভ্যে ফলে লোভাদুদ্বাহুরিব বামনঃ।
সুরীতি। এই-সব সংস্কৃত শ্লোকের জ্বালায় হাঁপিয়ে উঠলুম, একটু বিশুদ্ধ বাংলা বলো।
এর মধ্যে আশ্চর্যের কথা এই যে, সলিলার মৃত্যুর উল্লেখমাত্রও সে করল না।
এ দিকে ক্লাসের ঘণ্টার শব্দে দুজনকেই দ্রুত চলে যেতে হল, কিন্তু সংস্কৃত শ্লোকগুলো সুরীতির মনের ভিতরে দেবদারুর মতোই মহুর্মুহু কম্পিত হতে লাগল। সে দেখেছে আজকালে নীহারের ঠাট্টা আর সংস্কৃত শ্লোক আওড়ানো অন্য মেয়েরা খুব পছন্দ করে। তারা তাই নিয়ে ওকে প্রশংসা করে, তাই সেও বুঝেছে ওতে পরিহাসের কড়া স্বাদ নেই। সেইজন্য ইদানীং নীহারের হঠাৎ সংস্কৃত আবৃত্তিকে ভালো লাগাবার চেষ্টা করত।
এমন সময়ে একটা ঘটনা ঘটল যাতে ছাত্রছাত্রীদের মিলেমিশে কাজ করবার একটা সুযোগ হল। সর্বণ ইউনিভার্সিটির একজন ভারতপ্রত্নতত্ত্ববিদ্ পণ্ডিত আসবেন কলকাতা ইউনিভার্সিটির নিমন্ত্রণে। ছেলেমেয়েরা ঠিক করেছিল পথের মধ্যে থেকে তারাই তাঁকে অভ্যর্থনা করার গৌরব সর্বপ্রথমে লুটে নেবে। আগে ভাগে অধ্যাপকের কাছে গিয়ে তাঁকে ওদের প্রগতিসংঘের নিমন্ত্রণ জানালে। তিনি ফরাসী সৌজন্যের আতিশয্যে এই নিমন্ত্রণ স্বীকার করে নিলেন। তার পরে কে তার অভিনন্দন পাঠ করবে, সেটা ওরা ভালো করে ভেবে পাচ্ছিল না। কেউ বলছিল সংস্কৃত ভাষায় বলবে, কেউ বলছিল ইংরেজি ভাষাই যথেষ্ট—কিন্তু তা কারও মনঃপুত হল না। ফরাসী পণ্ডিতকে ফরাসী ভাষায় সম্মান প্রকাশ করাই উপযুক্ত ঠিক করল। কিন্তু করবে কে। বাইরের লোক পাওয়া যায়, কিন্তু সেটাতে তো সম্মান রক্ষা হয় না। এমন সময়ে নীহার রঞ্জন বলে উঠল, “আমার উপর যদি ভার দাও, আমি কাজ চালিয়ে নিতে পারব এবং ভালোরকমেই পারব।”
মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল যাদের নীহাররঞ্জনের উপর বিশেষ টান, তারা বললে—দেখা যাক্-না।
সুরীতির বিশেষ আপত্তি, সে বললে—একটা ভাঁড়ামি হয়ে উঠবে।
দলের মেয়েরা বললে, “আমরা বিদেশী, যদি বা আমাদের ভাষায় কিংবা বক্তৃতায় কোনো ত্রুটি হয় তা ফরাসী অধ্যাপক নিশ্চয়ই