প্রগতিসংহার

এই কলেজে ছেলেমেয়েদের মেলামেশা বরঞ্চ কিছু বাড়াবাড়ি ছিল। এরা প্রায় সবাই ধনী ঘরের—এরা পয়সার ফেলাছড়া করতে ভালোবাসে। নানারকম বাজে খরচ করে মেয়েদের কাছে দরাজ হাতের নাম কিনত। মেয়েদের মনে ঢেউ তুলত, তারা বুক ফুলিয়ে বলত—‘আমাদেরই কলেজের ছেলে এরা’। সরস্বতী পুজো তারা এমনি ধূম করে করত যে, বাজারে গাঁদা ফুলের আকাল পড়ে যেত। এ ছাড়া চোখ-টেপাটেপি ঠাট্টা তামাসা চলেইছে। এই তাদের মাঝখানে একটা সংঘ তেড়েফুঁড়ে উঠে মেলামেশা ছারখার করে দেবার জো করলে।

সংঘের হাল ধরে ছিল সুরীতি। নাম দিল ‘নারীপ্রগতিসংঘ’। সেখানে পুরুষের ঢোকবার দরজা ছিল বন্ধ। সুরীতির মনের জোরের ধাক্কায় এক সময়ে যেন পুরুষ-বিদ্রোহের একটা হাওয়া উঠল। পুরুষরা যেন বেজাত, তাদের সঙ্গে জলচল বন্ধ। কদর্য তাদের ব্যভার।

এবার সরস্বতী পুজোতে কোনো ধুমধাম হল না। সুরীতি ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের বলেছে জাঁক-জমকের হুল্লোড়ে তারা যেন এক পয়সা না দেয়। সুরীতির স্বভাব খুব কড়া, মেয়েরা তাকে ভয় করে। তা ছাড়া নারীপ্রগতিসংঘে দিব্যি গালিয়ে নিয়েছে যে-কোনো পালপার্বণে তারা কিছুমাত্র বাজে খরচ করতে পারবে না। তার বদলে যাদের পয়সা আছে পূজা-আর্চায় তারা যেন দেয় গরিব ছাত্রীদের বেতনসাহায্য বাবদ কিছু-কিঞ্চিৎ।

ছেলেরা এই বিদ্রোহে মহা খাপ্পা হয়ে উঠল। বললে, ‘তোমাদের বিয়ের সময় আমরা গাধার পিঠে বরকে চড়িয়ে যদি না নিয়ে আসি, তবে আমাদের নাম নেই।’

মেয়েরা বললে, ‘এ রকম জুড়ি গাধা, একটার পিঠে আর-একটা, আমাদের সংসারে কোনো কাজে লাগবে না। সে দুটি আমরা তোমাদের দরবারে গলায় মালা দিয়ে আর রক্তচন্দন কপালে পরিয়ে পাঠিয়ে দেব। তাদের আদর করে দলে টেনে নিয়ে নিয়ো।’

যাই হোক, এ কলেজে ছেলেতে মেয়েতে একটা ছাড়াছাড়ি হবার জো হল। ছেলেরা কেউ কাছে এসে কথা বলতে গেলেই মেয়েরা নাক তুলে বলতে আরম্ভ করলে ‘এ বড্ড গায়ে-পড়া’। ছেলেদের কেউ কেউ মেয়েদের পাশে বসে সিগারেট খেত—এখন সেটা তাদের মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে ফেলে দেয়। ছেলেদের উপর রূঢ় ব্যবহার করা ছিল যেন মেয়েদের আত্মগরিমা। কোনো ছেলে বাসে মেয়েদের জন্য জায়গা করে দিতে এগিয়ে এলে বিদ্রোহিণী বলে উঠত—‘এইটুকু অনুগ্রহ করবার কী দরকার ছিল! ভিড়ের মধ্যে আমরা কারও চেয়ে স্বতন্ত্র অধিকারের সুযোগ চাই নে।’

ওদের সংঘের একটা বুলি ছিল—ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে বুদ্ধিতে কম। দৈবাৎ প্রায়ই পরীক্ষার ফলে তার প্রমাণ হতে থাকত। কোনো পুরুষ যদি পরীক্ষায় তাদের ডিঙিয়ে প্রথম হত, তা হলে সে একটা চোখের জলের ব্যাপার হয়ে উঠত। এমন-কি তার প্রতি বিশেষ পক্ষপাত করা হয়েছে, স্পষ্ট করে এমন নালিশ জানাতেও সংকোচ করত না।

আগে ক্লাসে যাবার সময়ে মেয়েরা খোঁপায় দুটো ফুল গুঁজে যেত, বেশভূষার কিছু-না-কিছু বাহার করত। এখন তা নিয়ে এদের সংঘে ধিক্‌ ধিক্‌ রব ওঠে। পুরুষের মন ভোলাবার জন্যে মেয়েরা সাজবে, গয়না পরবে, এ অপমান মেয়েরা অনেকদিন ইচ্ছে করে মেনে নিয়েছে, কিন্তু আর চলবে না। পরনে বেরঙা খদ্দর চলিত হল। সুরীতি তার গয়নাগুলো দিদিমাকে দিয়ে বললে—‘এগুলো তোমার দান-খয়রাতে লাগিয়ে দিয়ো, আমার দরকার নেই, তোমার পুণ্যি হবে।’ বিধাতা যাকে যে রকম রূপ দিয়েছেন তার উপরে রঙ চড়ানো অসভ্যতা। এ-সমস্ত মধ্য আফ্রিকায় শোভা পায়। মেয়েরা যদি তাকে বলত—‘দেখ্‌ সুরীতি, অত বাড়াবাড়ি করিস নে।