প্রগতিসংহার
কাজ ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় অল্প বেতনে এক শিক্ষয়িত্রীর পদ নিলে। সেই বেতনের বারো-আনা যেত নীহাররঞ্জনের পেট ভরাতে, তার শখের জিনিস কিনে দিতে। এই ক্ষতিতেই ছিল তার আনন্দ। সে জানত মন ভোলাবার কোনো বিদ্যে তার জানাই ছিল না। এই কারণেই তার ত্যাগ এমন অপরিমিত হয়ে উঠল। এই ত্যাগেই সে অন্য মেয়েদের ছাড়িয়ে যেতে চাইছিল। তা ছাড়া আজকাল উল‍্‍টো প্রগতির কথা সে ক্রমাগত শুনে আসছে যে, মেয়েরা পুরুষের জন্য ত্যাগ করবে আপনাকে এইটাই হচ্ছে বিধাতার বিধান। পুরুষের জন্য যে মেয়ে আপনাকে না উৎসর্গ করে সে মেয়েই নয়। এই-সমস্ত মত তাকে পেয়ে বসল।

কলকাতায় যে বাসা সে ভাড়া করল খুব অল্প ভাড়ায়—স্যাঁৎসেতে, রোগের আড্ডা। তার ছাদে বের হবার জো নেই, কলতলায় কেবলই জল গড়িয়ে পড়ছে। তার উপরে যা কখনো জীবনে করে নি তাই করতে হল—নিজের হাতে রান্না করতে আরম্ভ করল। অনেক বিদ্যে তার জানা ছিল, কিন্তু রান্নার বিদ্যে সে কখনো শেখে নি। যে অখ্যাদ্য অপথ্য তৈরি হত, তা দিয়ে জোর করে পেট ভরাত। কিন্তু স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়ল। মাঝে মাঝে কাজ কামাই করতে বাধ্য হল ডাক্তারের সার্টিফিকেট নিয়ে। এত ঘন ঘন ফাঁক পড়ত কাজে যে অধ্যক্ষরা তাকে আর ছুটি মঞ্জুর করতে পারলেন না। তখন ধরা পড়ল ভিতরে ভিতরে তাকে ক্ষয়রোগে ধরেছে। বাসা থেকে তাকে সরানো দরকার, আত্মীয়-স্বজনরা মিলে তাঁকে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে ভরতি করে দিলে। কেউ জানত না কিছু টাকা তার গোপনে সঞ্চিত ছিল, সেই টাকা থেকেই তার বরাদ্দ-মতন দেয় নীহারের কাছে গিয়ে পৌঁছত। নীহার সব অবস্থাই জানত, তবু তার প্রাপ্য ব’লে এই টাকা সে অনায়াসে হাত পেতে নিতে লাগল। অথচ একদিন হাসপাতালে সুরীতিকে দেখতে যাবার অবকাশ সে পেত না। সুরীতি উৎসুক হয়ে থাকত জানলার দিকে কান পেতে, কিন্তু কোনো পরিচিত পায়ের ধ্বনি কোনোদিন কানে এল না। অবশেষে একদিন তার টাকার থলি নিঃশেষে শেষ হয়ে গেল আর সেই সঙ্গে তার চরম আত্মনিবেদন।