ল্যাবরেটরি

“যাক গে, আমাকে আর যে লোক যা মনে করুক-না, তিনি আমাকে যা মান দিয়েছেন, সে আজ পর্যন্ত টিঁকে আছে, আমার শেষ দিন পর্যন্ত থাকবে।”

“দেখো সোহিনী, তোমাকে যত দেখছি ততই জানছি, তুমি সে জাতের সহজ মেয়েমানুষ নও যারা স্বামী নামটা শুনলেই গ’লে পড়ে।”

“না, তা নই; আমি দেখেছি ওঁর মধ্যে শক্তি, প্রথম দিন থেকে জেনেছি উনি মানুষ, আমি শাস্ত্র মিলিয়ে পতিব্রতাগিরি করতে বসি নি। আমি জাঁক করেই বলছি, আমার মধ্যে যে রত্ন আছে সে একা ওঁরই কণ্ঠহারে দোলবার মতো, আর কারও নয়।”

এমন সময় নীলা ঘরে এসে ঢুকে পড়ল। বললে, “অধ্যাপকমশায়, কিছু মনে করবেন না, মায়ের সঙ্গে কিছু কথা আছে।”

“কিছু না মা, আমি এখন যাচ্ছি ল্যাবরেটরিতে। রেবতী কী রকম কাজ করছে দেখে আসি গে।”

নীলা বললে, “কোনো ভয় নেই। কাজ ভালোই চলছে। আমি এক-একদিন জানালার বাইরে থেকে দেখছি, উনি মাথা গুঁজে লিখছেন, নোট নিচ্ছেন, কলম কামড়ে ধরে ভাবছেন। আমার প্রবেশ নিষেধ, পাছে সার আইজাকের গ্রাভিটেশন যায় ন’ড়ে। সেদিন মা কাকে বলছিলেন উনি ম্যাগ্‌নেটিজ‍্ম্‌ নিয়ে কাজ করছেন,তাই পাশ দিয়ে কেউ গেলেই কাঁটা নড়ে যায়, বিশেষত মেয়েরা।”

চৌধুরী হো হো করে হেসে উঠলেন, বললেন, “মা, ল্যাবরেটরি ভিতরেই আছে, ম্যাগ্‌নেটিজ‍্ম্‌ নিয়ে কাজ চলছেই, কাঁটা যাঁরা নড়িয়ে দেন তাঁদের ভয় করতেই হয়। দিগ্‌ভ্রম ঘটায় যে। তবে চললুম।”

নীলা মাকে বললে, “আমাকে আর কতদিন তোমার আঁচলের গাঁঠ দিয়ে বেঁধে রাখবে। পেরে উঠবে না, কেবল দুঃখ পাবে।”

“তুই কী করতে চাস বল্‌।”

নীলা বললে, “তুমি তো জানই মেয়েদের জন্যে একটা হাইয়র স্টাডি মুভমেন্ট খোলা হয়েছে, তুমি তাতে অনেক টাকা দিয়েছ। সেখানে আমাকে কেন কাজে লাগাও-না।”

“আমার ভয় আছে পাছে তুই ঠিকমত না চলিস।”

“ সব চলাই বন্ধ করে দেওয়াই কি ঠিক চলার রাস্তা।”

“তা নয়, তা তো জানি, সেই তো আমার ভাবনা।”

“তুমি না ভেবে একবার আমাকে ভাবতে দাও না। সে তো দিতেই হবে। আমি তো এখন খুকি নই। তুমি ভাবছ সেই-সব পাবলিক জায়গায় নানা লোকের যাওয়া-আসা আছে, সে একটা বিপদ। জগৎসংসারে লোকচলাচল তো বন্ধ হবে না তোমার খাতিরে। আর তাদের সঙ্গে আমার জানাশুনো একেবারেই ঠেকিয়ে রাখবে যে সে আইন তো তোমার হাতে নেই।”

“জানি সব জানি, ভয় করে ভয়ের কারণ ঠেকিয়ে রাখতে পারব না। তা হলে তুই ওদের হাইয়র স্টাডি সার্কলে ভরতি হতে চাস? ”

“হাঁ চাই।”

“আচ্ছা তাই হবে। সেখানকার পুরুষ অধ্যাপকদের একে একে দিবি জাহান্নমে সে জানি। কেবল একটি কথা দিতে হবে আমাকে। কোনোমতেই তুই রেবতীর কাছে ঘেঁষতে পাবি নে। আর কোনো ছুতোতেই ঢুকবি নে তার ল্যাবরেটরিতে।”