পরিশিষ্ট
রামমোহন রায়
১
এ দেশে যে কীরূপে রাজা রামমোহনের জন্ম হইল, তাহা বুঝা যায় না। পারিপার্শ্বিক অবস্থা হইতে তাঁহার উৎপত্তি হয় নাই, তিনি সেই অবস্থার বহু উচ্চে অবস্থিত। অরুণচ্ছটা যেমন নিম্নভূমি অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন থাকা কালেও উন্নত পর্বতশিখ্রকে অনুরঞ্জিত করে, সেইরুপ স্বর্গীয় আলোক তাঁহার উন্নত আত্মাকে আলোকিত করিয়াছিল— বিশ্বমানবের মুক্তির বাণী তাঁহার নিকট পৌঁছিয়াছিল। মানবজীবনে যেমন একটা সময় আছে, যখন তাহাকে গৃহের মধ্যে আবদ্ধ থাকিয়াই বর্ধিত হইতে হয়, বাহিরে গেলেই তাহার বিপদ, তেমনি মানবসমাজেও এরূপ শিশুকাল আছে। যে-সকল সমাজ সেরূপভাবে রক্ষিত ও বর্ধিত হইয়াছে তাহারাই আজও বাঁচিয়া আছে। কিন্তু শিশুকাল অতিক্রান্ত হইলে যেমন তাহাকে বাহিরে বিশ্বজগতের মধ্যে যাইতে হয়, তাহা না হইলে তাহার উন্নতি ও বিকাশ হইতে পারে না, তেমনি যে সমাজ চিরকাল আপনার ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে, বিশ্বমানবের সঙ্গে যুক্ত হয় না, তাহারও উন্নতি অসম্ভব হইয়া উঠে।ভারতকে বিশ্ব-মানবের সঙ্গে যুক্ত করিবার জন্যই রামমোহন আসিয়াছিলেন। শুধু ভারতের জন্য নয়, বিশ্বমানবের জন্য মুক্তির বাণী লইয়া তিনি আসিয়াছিলেন। তিনি সমগ্র দৃষ্টি, সমগ্র ভবিষৎ আপনার মধ্যে ধরিয়াছেন। চারিদিকের অন্ধকার মধ্যে দাঁড়াইয়া যেন তিনি জ্বলন্ত ভাষায় বলিয়াছেন—
‘বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তমাদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।’
‘এই অন্ধকারের পরপারস্থিত জ্যোতির্ময় মহান পুরুষ্কে জানিয়াছি।’ সেই মহান পুরুষকে জানিয়াই তিনি বলিয়াছিলেন, ‘ভুমৈব সুখং নাল্পে সুখমস্তি’— ভূমাতেই সুখ, ক্ষুদ্রে সুখ নাই। আমরা ক্ষুদ্র লইয়া তৃপ্ত থাকিতে পারি না। ক্ষুদ্র দেশে আবদ্ধ থাকিলে হইবে না। দেশকে বিশ্বের অন্তর্গত করিয়া ভালোবাসিতে হইবে। সকলের মধ্যে ব্রহ্মকে দেখিতে হইবে। রামমোহন যে বীজ বপন করিয়া গিয়াছেন সে-শস্য আমরা কর্তন করিব। আমরা তাঁহারাই অনুসরণ করিয়া চলি, তাঁহার বাণী শুনিয়া চলি। আমরা ক্ষুদ্রে ডুবিয়া থাকিতে পারি না। মহান ব্রহ্ম আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়দ্বারে অতিথিরূপে উপস্থিত। এই অতিথিকে স্থান দিতে হইবে। প্রত্যাখ্যান করিলে আমাদের সর্বনাশ হইবে। আমরা কেহ ছোট নই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যাহারা বড়ো তাহারাও চূর্ণ হইয়া গিয়াছে, অহংকারী বিধ্বস্ত হইয়া গিয়াছে, আর যে ছোটো সে বড়ো হইয়াছে। ইতিহাসে ইহার উজ্জ্বল প্রমাণ রহিয়াছে। আমরাও ছোট নই, ছোট থাকিব না। সেই মহাবাণী শুনিয়া চলি, সেই নেতার অধীন হইয়া চলি, আমরাও বড়ো হইয়া উঠিব, এ দেশ বড়ো হইয়া উঠিবে।