পরিশিষ্ট
ভুলিয়াছিলেন ইতিহাসের রূপ দেশকে আশ্রয় করিয়া এক-এক স্থলে এক-এক ভাবে প্রকাশিত হয়। এইরূপ অনুসরণ করা যায় না। ইতিহাসের মধ্যে যে সত্য নিহিত আছে ওই সত্য সকল দেশেই এক।

রাজনারায়ণবাবুর বাংলা সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ অতি আশ্চর্যের বিষয়। তিনি ডিরোজিয়োর শিষ্য, ইংরেজি ভাষায় সুপণ্ডিত, ওই ভাশাতেই চিরদিন ভাব প্রকাশে অভ্যস্থ। অথচ বাংলা সাহিত্যের সেবায় আত্মশক্তি নিয়োগ করেন।

তিনি যখন এই সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন, তখন এই সাহিত্যের শিশু অবস্থা। তখন ইহার মধ্যে আকর্ষনের কিছু ছিল না।তাহাকে যদি সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাইয়া জিজ্ঞাসা করা হইত — “এই ভাষায় কী আছে যে তুমি এই ভাষার সেবা করিবে?” উত্তরে তিনি কিছুই দেখাতে পারিতেন না। কিন্তু তিনি তো অমনভাবে দেখেন নাই। এই শিশুর সূতিকাগৃহে যখন মঙ্গলশঙ্খ বাজিয়াছিল তিনি সেই ধ্বনির মধ্যে ভবিষ্যতের গৌরববাণী নিঃসন্দেহ শুনিয়াছিলেন, তিনি শিশুর মুখমণ্ডলে ভবিষ্যতের গৌরবচ্ছবি প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন; এইজন্যই তিনি বঙ্গসাহিত্যর সেই শিশুকালেই ইহাকে যে আসন প্রদান ক্রিয়াছিলেন এখনো বিজ্ঞ পণ্ডিতেরা সেই গৌরব দান করিতে চাহেন না। এইজন্য তিনি ওই সময়েই বঙ্গসাহিত্যের উন্নতি বিধান না করিলে বাঙালির উন্নতি হইতে পারে না ইহা সুস্পষ্ট বুঝিতেন।

আমার তিনি বিশেষ উৎসাহদাতা ছিলেন। ১৮ বছরের সময় ইংলন্ড হইতে ফিরিয়া আমি ভারতীতে যাহা লিখিতাম, তাহা পাঠ করিয়া আমার লজ্জা হয়। তাহা এখনো ছাপার অক্ষরে আমার প্রতি চাহিয়া লজ্জিত করে। রাজনারায়ণবাবু তাহা পরম আগ্রহে পড়িতেন, প্রত্যেকটি বাক্যের সমালোচনা করিয়া দেওঘর হইতে দীর্ঘ পত্র লিখিতেন। তাঁহার সহৃদয়তাপূর্ণ পত্র পাইবার জন্য আমি উৎকণ্ঠিত হইয়া থাকিতাম।

ছোটো শিশুদের প্রতি রাজনারায়ণবাবুর অসীম শ্রদ্ধা ছিল। যাঁহারা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন তাঁহারা অনেকে শিশুদের মধ্যে কেবল দোষই দেখেন, তাঁহাদের উপর কেবল অশ্রদ্ধাই প্রকাশ করেন। রাজনারায়ণবাবু যখন পক্বকেশ বৃদ্ধ, তখন আমায় বয়স ৮ বছর; ওই বয়সে তিনি আমার বয়স্য ছিলেন, আমার সহিত তাঁহার মেলামেশার কোনো বাধা ছিল না। তাঁহার এই শিশুপ্রীতির মূলে অসীম বিশ্বাস ছিল। শিশুদের মধ্যে যে পরিণাম আছে তিনি তাহা প্রত্যক্ষ করিতে পারিতেন। জগতের একজন মহাপুরুষ বলিয়াছেন— “ শিশুদের আমার নিকট আসিতে দাও।”

আমি যে এখন শিশু ও যুবকদিগকে ভালোবাসিতে পারি, ইহার মুলে দুই ব্যক্তি আছেন। প্রথম আমার পিতা। তিনি কোনোদিন আমাকে বালক বলিয়া অবজ্ঞা করেন নাই। তাঁহার সহিত আমার আলাপ-অলোচনা হাস্যপরিহাস সকলই চলিত। তিনি আমাকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিতেন। আমাকে সর্বপ্রকারে উৎসাহিত করিতেন।

দ্বিতীয় রাজনারায়ণবাবু। তিনি আমার সহিত সমবয়সীর মতো মিশিতেন।

আমাদের গৃহের দক্ষিণের কক্ষে দ্বিপহর সময়ে তিনি শুইয়া থাকিতেন। তখন আমরা নির্ভয়ে ওই কক্ষে কোলাহল করিতাম। হয়তো তাঁহার সম্বন্ধে কত কথা বলিতাম। তিনি সময়ে সময়ে চক্ষু মেলিয়া চাহিতেন। যেন বলিতেন, তোমারা ভাবিয়াছ আমি ঘুমাইয়া আছি, তাহা নহে, এই দেখো আমি দিব্য জাগিয়া আছি।

আমার সহিত সেই সময়ের প্রত্যক্ষ পরিচয়ের আনন্দস্মৃতি বহন করিয়া আমি আপনাদের নিকট উপস্থিত হইয়াছি এবং আজ তাঁহার শ্রাদ্ধবাসরে আমার অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করিতেছি।