প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
জগতের প্রেমে আমরা কেন মজিতে চাহি না? আমরা আপনাকে বজায় রাখিতে চাই বলিয়া। আমরা চাই আমি বলিয়া এক ব্যক্তিকে স্বতন্ত্র করিয়া রাখিব, তাহাকে কোনমতে হাতছাড়া করিব না। জগৎকে বেষ্টন করিয়া চারি দিকে প্রেমের জাল পাতা রহিয়াছে। অহর্নিশি জগতের চেষ্টা তোমাকে তাহার সহিত এক করিয়া লইতে। জগতের ইচ্ছা নহে যে, তাহার কোন একটা অংশ, কোন একটা ঢেউ, স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করিয়া জগতের স্রোতকে হুট্ করিয়া দিয়া উজানে বহিয়া যায়। সে চায় সকল ঢেউগুলি একস্রোতে বহে, এক গান গায়, তাহা হইলেই সমস্ত জগতের একটি সামঞ্জস্য থাকে – জগতের মহাগীতের মধ্যে কোনখানে বেসুরা লাগে না। এই নিমিত্ত যে ব্যক্তি জগতের প্রতিকূলে “আমি আমি” করিয়া খাড়া থাকিতে চায় সে ব্যক্তি বেশী দিন টিঁকিতে পারে না। ক্ষুদ্র নিজের মধ্যে নিজের অভাব পূর্ণ হয় না। অবশেষে সে দুঃখে শোকে তাপে জর্জ্জর হইয়া জগতের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া হাঁপ ছাড়ে। এক গণ্ডূষ জলের মধ্যে মাছ ততক্ষণ তিষ্ঠিতে পারে? কিছু দিনের মধ্যেই তাহার খোরাক ফুরাইয়া যায়, জল দূষিত হইয়া পড়ে, সমুদ্রের জন্য তাহার প্রাণ ছট্ফট্ করে। তখন সমুদ্রে যদি না যাইতে পারে, বড় মাছ হইলে শীঘ্র মরে, ছোট মাছ হইলে কিছু দিন মাত্র টিঁকিয়া থাকে। তেমনি যাহাদের বড় প্রাণ তাহারা বেশি দিন নিজের মধ্যে বন্ধ হইয়া থাকিতে পারে না, জগতে ব্যাপ্ত হইতে চায়। চৈতন্যদেব ইহার প্রমাণ। যাহাদের ছোট প্রাণ তাহারা অনেক দিন নিজেকে লইয়া টিঁকিতে পারে, কিন্তু তাই বলিয়া চিরকাল পারিবে না, অনন্তকালের খোরাক আমার মধ্যে নাই। দুর্ভিক্ষে পীড়িত হইয়া তাহারা বাহির হইয়া পড়ে। এত কথা যে বলিলাম তাহা নিম্নলিখিত গানটির মধ্যে আছে।–
ওরে মন পাখী, চাতুরী করবে বলো কত আর!
বিধাতার প্রেমের জালে পড়বে না কি একবার!
সাবধানে ঘুরে ফিরে থাক বাহিরে বাহিরে,
জাল কেটে পালাও উড়ে ফাঁকি দিয়ে বার বার!
তোমায় একদিন ফাঁদে পড়তে হবে, সব চালাকি ঘুচে যাবে–
অন্ন জল বিনে যখন করবে দুঃখে হাহাকার!
গ্রন্থে প্রেমের গান এত আছে, এবং এক একটি গান শুনিয়া এত কথা মনে পড়ে, যে, সকল গান তুলিলে, সকল কথা বলিলে পুঁথি বাড়িয়া যায়।
প্রকাশকের সহিত এক বিষয়ে কেবল আমাদের ঝগড়া আছে। তিনি ব্রক্ষ্মসঙ্গীত ও আধুনিক ইংরাজিওয়ালাদিগের রচনাকে ইহার মধ্যে স্থান দিলেন কেন? আমরা ত ভাল গান শুনিবার জন্য এ বই কিনিতে চাই না। অশিক্ষিত অকৃত্রিম হৃদয়ের সরল গান শুনিতে চাই। প্রকাশক স্থানে স্থানে তাহার বড়ই ব্যাঘাত করিয়াছেন।
আমরা কেন যে প্রাচীন ও ইংরাজিতে অশিক্ষিত লোকের রচিত সঙ্গীত বিশেষ করিয়া দেখিতে চাই তাহার কারণ আছে। আধুনিক শিক্ষিত লোকদিগের অবস্থা পরস্পরের সহিত প্রায় সমান। আমরা সকলেই একত্রে শিক্ষালাভ করি, আমাদের সকলের হৃদয় প্রায় এক ছাঁচে ঢালাই করা। এই নিমিত্ত আধুনিক হৃদয়ের নিকট হইতে আমাদের হৃদয়ের প্রতিধ্বনি পাইলে আমরা তেমন চমৎকৃত