বাউলের গান
সংগীত সংগ্রহ। বাউলের গাথা
এমন কোনো কোনো কবির কথা শুনা গিয়াছে, যাঁহারা জীবনের প্রারম্ভ ভাগে পরের অনুকরণ করিয়া লিখিতে আরম্ভ করিয়াছেন-অনেক কবিতা লিখিয়াছেন, অনেক ভালো ভালো কবিতা লিখিয়াছেন, কিন্তু সেগুলি শুনিলে মনে হয় যেন তাহা কোনো একটি বাঁধা রাগিণীর গান, মিষ্ট লাগিতেছে, কিন্তু নূতন ঠেকিতেছে না। অবশেষে এইরূপ লিখিতে লিখিতে, চারি দিক হাতড়াইতে হাতড়াইতে, সহসা নিজের যেখানে মর্মস্থান, সেইখানটি আবিষ্কার করিয়া ফেলেন। আর তাঁহার বিনাশ নাই। এবার তিনি যে গান গাহিলেন তাহা শুনিয়াই আমরা কহিলাম, বাঃ, এ কি শুনিলাম! এ কে গাহিল! এ কি রাগিণী! এত দিন তিনি পরের বাঁশি ধার করিয়া নিজের গান গাহিতেন, তাহাতে তাঁহার প্রাণের সকল সুর কুলাইত না। তিনি ভাবিয়া পাইতেন না – যাহা বাজাইতে চাহি তাহা বাজে না কেন! সেটা যে বাঁশির দোষ! ব্যাকুল হইয়া চারি দিকে খুঁজিতে খুঁজিতে সহসা দেখিলেন তাঁহার প্রাণের মধ্যেই একটা বাদ্য আছে। বাজাইতে গিয়া উল্লাসে নাচিয়া উঠিলেন; কহিলেন, “এ কী হইল। আমার গান পরের গানের মত শোনায় না কেন? এত দিন পরে আমার প্রাণের সকল সুরগুলি বাজিয়া উঠিল কি করিয়া? আমি যে কথা বলিব মনে করি সেই কথাই মুখ দিয়া বাহির হইতেছে!” যে ব্যক্তি নিজের ভাষা আবিষ্কার করিতে পারিয়াছে, যে ব্যক্তি নিজের ভাষায় নিজে কথা কহিতে শিখিয়াছে, তাহার আনন্দের সীমা নাই। সে কথা কহিয়া কি সুখীই হয়! তাহার এক-একটি কথা তাহার এক-একটি জীবিত সন্তান। ঘরের কাছে একটি উদাহরণ আছে। বঙ্কিমবাবু যখন দুর্গেশনন্দিনী লেখেন তখন তিনি যথার্থ নিজেকে আবিষ্কার করিতে পারেন নাই। লেখা ভালো হইয়াছে, কিন্তু উক্ত গ্রনেথ সর্বত্র তিনি তাঁহার নিজের সুর ভালো করিয়া লাগাইতে পারেন নাই। কেহ যদি প্রমাণ করে, যে, কোনো একটি ক্ষমতাশালী লেখক অন্য একটি উপন্যাস অনুবাদ বা রূপান্তরিত করিয়া দুর্গেশনন্দিনী রচনা করিয়াছেন, তবে তাহা শুনিয়া আমরা নিতান্ত আশ্চর্য হই না। কিন্তু কেহ যদি বলে, বিষবৃক্ষ, চন্দ্রশেখর বা বঙ্কিমবাবুর শেষ-বেলাকার লেখাগুলি অনুকরণ, তবে সে কথা আমরা কানেই আনি না।
ব্যক্তিবিশেষ সম্বন্ধে যাহা খাটে, জাতি সম্বন্ধেও তাহাই খাটে। চারি দিক দেখিয়া শুনিয়া আমাদের মনে হয় যে, বাঙালি জাতির যথার্থ ভাবটি যে কী তাহা আমরা সকলে ঠিক ধরিতে পারি নাই-বাঙালি জাতির প্রাণের মধ্যে ভাবগুলি কিরূপ আকারে অবস্থান করে তাহা আমরা ভালো জানি না। এই নিমিত্ত আধুনিক বাংলা ভাষায় সচরাচর যাহা কিছু লিখিত হইয়া থাকে তাহার মধ্যে যেন একটি খাঁটি বিশেষত্ব দেখিতে পাই না। পড়িয়া মনে হয় না, বাঙালিতেই ইহা লিখিয়াছে, বাংলাতেই ইহা লেখা সম্ভব এবং ইহা অন্য জাতির ভাষায় অনুবাদ করিলে তাহারা বাঙালির হৃদয়-জাত একটি নূতন জিনিষ লাভ করিতে পারিবে। ভাল হউক মন্দ হউক, আজকাল যে সকল লেখা বাহির হইয়া থাকে তাহা পড়িয়া মনে হয়, যেন এমন লেখা ইংরাজিতে বা অন্যান্য ভাষায় সচরাচর লিখিত হইয়া থাকে বা হইতে পারে। ইহার প্রধান কারণ, এখনো আমরা বাঙালির ঠিক ভাবটি, ঠিক ভাষাটি ধরিতে পারি নাই! সংস্কৃতবাগীশেরা বলিবেন, ঠিক কথা বলিয়াছ, আজকালকার লেখায় সমাস দেখিতে পাই না, বিশুদ্ধ সংস্কৃত কথার আদর নাই, এ কী বাংলা! আমরা তাঁহাদের বলি, তোমাদের ভাষাও বাংলা নহে, আর ইংরাজিওয়ালাদের ভাষাও বাংলা নহে। সংস্কৃত ব্যাকরণেও বাংলা নাই, আর ইংরাজি ব্যাকরণেও বাংলা নাই, বাংলা ভাষা বাঙালিদের হৃদয়ের মধ্যে আছে। ছেলে কোলে করিয়া সহরময় ছেলে খুঁজিয়া বেড়ান যেমন, তোমাদের ব্যবহারও তেমনি দেখিতেছি। তোমরা বাংলা বাংলা করিয়া সর্বত্র খুঁজিয়া বেড়াইতেছ, সংস্কৃত ইংরাজি সমস্ত ওলট্-পালট্ করিতেছ, কেবল একবার হৃদয়টার মধ্যে অনুসন্ধান করিয়া দেখ নাই।