মন্ত্রি-অভিষেক
অনুভব করিতে চাই, তবে আমাদের শিক্ষা ও চরিত্র সম্পূর্ণতা লাভ করিবে। হিউম্‌কে নিকটে পাইয়া আমাদের ইংরাজি ইতিহাসশিক্ষার ফল সর্ম্পূণতা প্রাপ্ত হইতেছে—নতুবা আমরা যে-সকল উদাহরণ দেখিয়াছি ও দেখিতেছি, তাহাতে সে শিক্ষা অনেক পরিমাণে নিষ্ফল হইয়া যাইতেছিল।

অতএব কন্‌গ্রেসের দ্বারায় উত্তরোত্তর আমাদের যথার্থ রাজভক্তি বৃদ্ধি হইতেছে এবং মহৎ মনুষ্যত্বের নিকট সংস্পর্শ লাভ করিয়া আমাদের জীবনের মধ্যে অলক্ষিতভাবে মহত্ত্ব সঞ্চারিত হইতেছে।

আমরা কথা কহি বলিয়া যে ইংরাজি সম্পাদকেরা আমাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেন, তাঁহাদের মনের ভাব যে কি তাহা ঠিক জানি না। বোধ করি তাঁহারা বলিতে চান “তোমরা কাজ করো”। ঠিক সেই কথাটাই হইতেছে। কাজ করিতেই চাই। সেই জন্যই আগমন। যখন আমরা কাজ চাহিতেছি তখন তোমরা বলিতেছ, “কথা কহিতেছ কেন! “ আচ্ছা, দাও কাজ।

অমনি তোমরা তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিবে,”না না, সে কাজের কথা হইতেছে না—তোমরা আপন সমাজের কাজ করো!”

আমরা সমাজের কাজ করি কি না করি সে খবর তোমরা রাখ কি? যখনি কাজ চাহিলাম অমনি আমাদের সমাজের প্রতি তোমাদের সহসা একান্ত অনুরাগ জন্মিল। আমাদের সমাজের কাজে যদি আমরা কোন শৈথিল্য করি আমাদের চৈতন্য করাইবার লোক আছে; জানইত বাক্‌শক্তিতে আমরা দুর্ব্বল নহি। অতএব পরামর্শ বিলাত হইতে আমদানি করা নিতান্ত বাহুল্য।

যাঁহারা রাজনীতিকে সমাজনীতির অপেক্ষা প্রাধান্য দিয়া থাকেন, যাঁহারা রাজ-পুরুষদের কর্ত্তব্যবুদ্ধি উদ্রেক করাইতে নিরতিশয় ব্যাপৃত থাকিয়া নিজের কর্ত্তব্যকার্য্যে অবহেলা করেন, তাঁহারা অন্যায় করেন এবং সে সম্বন্ধে আমাদের স্বজাতীয়দিগকে সর্তক করিয়া দিবার জন্য আমরা মাঝে মাঝে চেষ্টার ত্রুটি করি না। শ্রোতৃবর্গ বোধ করি বিস্মৃত হইবেন না, বর্ত্তমান বক্তাও ক্ষুদ্রবুদ্ধি ও ক্ষুদ্রশক্তি অনুসারে মধ্যে মধ্যে অগত্যা এইরূপ অপ্রীতিকর চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন।

কর্ত্তব্যের আপেক্ষিক গুরুলঘুতা সকল সময়ে সূক্ষ্মভাবে বিচার করিয়া চলা কোন জাতির নিকট হইতে আশা করা যাইতে পারে না। অন্ধতা, হৃদয়ের সঙ্কীর্ণতা বা কৃত্রিম প্রথা দ্বারা নীত হইয়া তোমাদের স্বজাতীয়েরা যখনি যথার্থ পথ পরিত্যাগ করিয়াছে এবং অপ্রকৃতকে প্রকৃতের অপেক্ষা অধিকতর সম্মান দিয়াছে, তখনি তোমাদের চিন্তাশীল পণ্ডিতগণ, তোমাদের কার্লাইল, ম্যাথ্যুআর্ণল্ড, রস্কিন্‌ স্বজাতিকে সতর্ক করিতে ভূয়োভূয়ঃ চেষ্টা করিয়াছেন।

তাঁহাদের সে চেষ্টা সফল হইতেছে কি না বলা কঠিন। কারণ, সামাজিক সংস্কারকার্য্য অপেক্ষাকৃত নিঃশব্দে নিগুঢ় অলক্ষিতভাবে সাধিত হইয়া থাকে। নৈসর্গিক জীবন্তশক্তির ন্যায় সে আপনাকে গোপন করিয়া রাখে। তাহার প্রতিদিনের প্রত্যক্ষ হিসাব পাওয়া দুঃসাধ্য।

আমাদের সমাজেও সেইরূপ জীবনের কার্য্য চলিতেছে, তাহা বিদেশীয় দৃষ্টিগোচর নহে। এমন-কি স্বদেশীয়ের পক্ষেও সমাজের পরিবর্ত্তন প্রতি মুহূর্ত্তে অনুভবযোগ্য হইতে পারে না।

অতএব আমাদের সমাজের ভার আমাদের দেশের চিন্তাশীল লোকদের প্রতি অর্পণ করিয়া যে কথাটা তোমাদের কাছে উঠিয়াছে আপাততঃ তাহারই উপযুক্ত যুক্তি দ্বারা তাহার বিচার কর। বল যে “তোমরা অযোগ্য” অথবা বল যে “আমাদের ইচ্ছা নাই”—কিন্তু “তোমাদের বাল্যবিবাহ আছে” বা “বিধবাবিবাহ নাই” এ কথাটা নিতান্তই অসংলগ্ন হইয়া পড়ে। সামাজিক অসম্পূর্ণতা তোমাদের দেশেও আছে এবং পূর্ব্বে হয়ত আরো অনেক ছিল, কিন্তু সে কথা বলিয়া তোমাদের বক্তৃতা কেহ বন্ধ করে নাই, তোমাদের রাজনৈতিক প্রার্থনা কেহ নিরাশ করে নাই।

তোমরা এমন কথাও বলিতে পারিতে যে “তোমাদের দেশে আমাদের মত এমন সঙ্গীতচর্চ্চা ও চিত্রশিল্পের আদর এখনো হয় নাই অতএব তোমাদের কোন কথাই শুনিতে চাহি না”। ইহা অপেক্ষা বলা ভাল “আমার ইচ্ছা আমি শুনিব না”, তাহাতে