প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
আমাদের একমাত্র বিশ্বাস কথার উপরে—হয়ত আমাদের কোন কোন মুসলমান ভ্রাতার তাহা নাই— এজন্য বরং তোমাদের নিকট হইতেও আমরা বাক্যবাগীশ নামে অভিহিত হইতে রাজি আছি, তথাপি কন্গ্রেসের বিরোধী পক্ষে যোগ দিতে পারিব না। তোমাদের প্রতি ভক্তি আছে বলিয়াই কথা কহি, নহিলে নীরব হইয়া থাকিতাম তাহার আর সন্দেহ নাই। অতএব তোমরা কন্গ্রেসের প্রতি সন্দিগ্ধভাব দূর করিয়া কন্গ্রেসের চতুর মৌনী বিরোধী পক্ষের প্রতি সন্দেহ সহাপন করো।
কন্গ্রেস আর এক উপায়ে রাজভক্তি শিক্ষা দিতেছে।
ইংরাজেরই মহিমা কন্গ্রেসের অস্থিমজ্জার মধ্যে জীবন সঞ্চার করিতেছে। ইংরাজেরই মহৎ উজ্জ্বল অপূর্ব্ব নিঃস্বার্থ প্রীতি কন্গ্রেসের মর্ম্মের মধ্যে প্রতিষ্ঠা স্থাপন করিয়া তাহাকে অলৌকিক বলে বলীয়ান্ করিতেছে। বাহিরে পায়োনিয়রের স্তম্ভে, রাজকর্ম্মচারীদের প্রকাশ্য ও গোপন কার্য্যপ্রণালীর মধ্যে, ইংরাজের যে অনুদারতার পরিচয় পাইতেছি —এ দিকে দুর্ভাগা দরিদ্র জাতির জন্য হিউমের সম্পূর্ণ আত্মবিসর্জ্জন, ইউল ও বেডর্বর্ণের জ্যোতির্ম্ময় সহৃদয়তা আমাদের অত্যন্ত নিকটে থাকিয়া আমাদের অন্তরের সমস্ত আবরণ ভেদ করিয়া তাহার প্রতিবাদ করিতেছে।
ইংরাজ জাতি যে কত মহৎ কন্গ্রেস না থাকিলে তাহার এমন নিকট প্রমাণ পাইবার আমাদের অবসর হইত না। সেই প্রমাণ পাইবার অতন্ত আবশ্যক হইয়াছিল। ভারতবর্ষে ইংরাজে এবং ভারতবর্ষীয়ের মধ্যে প্রত্যক্ষ স্বার্থের সংঘর্ষ—এবং ইংরাজ এখানে প্রভুপদে প্রতিষ্ঠিত, ক্ষমতামদে মত্ত, সুতরাং স্বভাবতঃ ইংরাজের ব্যক্তিগত মহত্ব ভারতবর্ষে তেমনি স্ফূর্ত্তি পায় না, বরঞ্চ তাহার ক্ষুদ্রতা নিষ্ঠুরতা ও দানবভাব অনেক সময়ে সজাগ হইয়া উঠে।
এ দিকে ইংরাজি সাহিত্যে আমরা ইংরাজি চরিত্রের উচ্চ আদর্শ দেখিতে পাই, অথচ সাক্ষাৎসম্পর্কে ইংরাজের মধ্যে তাহার পরিচয় পাই না —এইরূপে য়ুরোপীয় সভ্যতার উপর আমাদের অবিশ্বাস ক্রমশঃ বদ্ধমূল হইয়া আসিতেছিল। আমাদের শিক্ষিত লোকদের মনে অল্প দিন হইল ইংরাজের ঊনবিংশ শতাব্দীর স্পর্দ্ধিত সভ্যতার উপর এইরূপ একটা ঘোরতর সংশয় জন্মিয়াছে। সমস্ত ফাঁকি বলিয়া মনে হইতেছে। সকলে ভীত হইয়া মনে করিতেছেন আমাদের প্রাচীন রীতিনীতির জীর্ণ দুর্গের মধ্যে আশ্রয় লওয়াই সর্ব্বাপেক্ষা নিরাপদ। ইংরাজি সভ্যতার মধ্যে সহৃদয়তা ও অকৃত্রিমতা নাই।
ইহার প্রধান কারণ ইংরাজের নিকট হইতে সহৃদয়তা প্রত্যাশা করিয়া আমরা নিরাশ হইয়াছি, এবং আমাদের আহত হৃদয়ের বেদনায় ইংরাজি সভ্যতাকে আমরা সম্পূর্ণ অস্বীকার করিতে চেষ্টা করিতেছি। এমন সময়ে হিউম, ইউল, বেডর্বর্ণ কন্গ্রেসকে অবলম্বন করিয়া আমাদের সেই নষ্ট বিশ্বাস উদ্ধার করিতে অগ্রসর হইয়াছেন। ইহাতে যে কেবল আমাদের রাজনৈতিক উন্নতি হইবে তাহা নহে, ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমরা যে নূতন শিক্ষা নূতন সভ্যতার আশ্রয়ে আনীত হইয়াছি তাহার প্রতি বিশ্বাস বলিষ্ঠ হইয়া তাহার সুফলসকল স্বেচ্ছাপূর্ব্বক অন্তরের মধ্যে গ্রহণ করিতে পারিব এবং এইরূপে আমাদের সর্ব্বাঙ্গীণ উন্নতি হইবে। আমরা ইতিহাসে ও সাহিত্যে ইংরাজের যে মহৎ আদর্শ লাভ করিয়াছি সেই আদর্শ মূর্ত্তিমান ও জীবন্ত হইয়া আমাদিগকে মনুষ্যত্বের পথে অগ্রসর করিয়া দিবে।
আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রের মধ্যে যতই সাধুপ্রসঙ্গ ও সৎশিক্ষা থাক্ তাহা এক হিসাবে মৃত, কারণ যে সকল মহাপুরুষেরা সেই সাধুভাব সকলকে প্রদান করিয়াছিলেন এবং তাহা হইতে পুনশ্চ প্রাণলাভ করিয়াছিলেন, তাঁহারা আর বর্ত্তমান নাই—কেবল শুষ্ক শিক্ষায় অসাড় জীবনকে চৈতন্যদান করিতে পারে না। আমরা মানুষ চাই। বর্ত্তমান সভ্যতা যাঁহাদিগকে মহৎজীবন দান করিয়াছে এবং যাঁহারা বর্ত্তমান সভ্যতাকে সেই জীবন প্রত্যর্পণ করিয়া সঞ্জীবিত করিয়া রাখিয়াছেন সেই সকল মহাপুরুষের মহৎ প্রভাব প্রত্যক্ষ