মন্ত্রি-অভিষেক
তোমাদেরও কথা অনেকটা সংক্ষেপ হইয়া আসে। কিন্তু তোমাদের জাতির মধ্যেই তোমাদের অপেক্ষা আরো উচ্চ বিচারশালা আছে, সেই জন্যই আমরা আশা ত্যাগ করি নাই এবং সেই জন্যই আমাদের কন্‌গ্রেস।

যদিও আমার এ-সকল কথা তোমাদের কর্ণগোচর হইবার কোন সম্ভাবনা নাই—কারণ, আমাদের সমাজের মঙ্গলের প্রতি তোমাদের অত্যন্ত প্রচুর অনুরাগ সত্ত্বেও আমাদের ভাষা তোমরা জান না, জানিতে ইচ্ছাও কর না—তথাপি দুরাশায় ভর করিয়া আমাদের কন্‌গ্রেসের প্রতি তোমাদের অকারণ অবিশ্বাস দূর করিবার জন্য মাঝে হইতে তৎসম্বন্ধে এতটা কথা বলিলাম। দেখাইলাম তোমাদের প্রতি ভক্তিই কন্‌গ্রেসের একমাত্র আশা ও সম্বল।

অতএব কন্‌গ্রেসের নিকট হইতে যে প্রস্তাব উত্থাপিত হইতেছে তাহার প্রতি এমন ভ্রূকুটি করিয়া থাকা তোমাদের বিবেচনার ভুল। তাহার প্রতি প্রসন্ন কর্ণপাত করা রাজনৈতিক ধর্মনৈতিক সকল প্রকার কারণে তোমাদের কর্ত্তব্য। কারণ, কন্‌গ্রেস জেতৃ ও জিত—জাতির মধ্যে সেতুবন্ধন করিয়া দিতেছে।

গবর্নমেন্টের দ্বারা মন্ত্রিনিয়োগ অপেক্ষা সাধারণ লোকের দ্বারা মন্ত্রি-অভিষেক অনেক কারণে আমাদের নিকটে প্রার্থনীয় মনে হয়।

পূর্ব্বেই বলিয়াছি সন্তোষ একটি প্রধান কারণ। আমাদের শিক্ষিতমন্ডলী এই অধিকার প্রার্থনা করিতেছে। যদি ইহা দান করিলে গবর্নমেন্টের কোন ক্ষতি না হয় ত প্রজারঞ্জন একটা মহৎলাভ।

গবর্ণমেন্ট শব্দটা শুনিবামাত্র হঠাৎ ভ্রম হয় যেন তাহা মানবধর্ম্মবিবর্জ্জিত নির্গুণ পদার্থ। যেন তাহা রাগদ্বেষবিহীন। যেন তাহা স্তবে বিচলিত হয় না, বাহ্য চাকচিক্যে ভোলে না, যেন তাহার আত্মপরবিচার নাই, যেন তাহা নিরপেক্ষ কটাক্ষের দ্বারা মন্ত্রবলে মানবচরিত্রের রহস্য ভেদ করিতে পারে। অতএব এরূপ অপক্ষপাতী সর্ব্বদর্শী অলৌকিক পুরুষের হস্তেই নির্ব্বাচনের ভার থাকিলেই যেন ভাল হয়।

কিন্তু আমরা নিশ্চয় জানি গবর্ণমেন্ট আমাদেরই ন্যায় অনেকটা রক্তমাংসে গঠিত। উক্ত গবর্ণমেন্ট নিমন্ত্রণে যান, বিনীত সম্ভাষণে আপ্যায়িত হন, লন্‌টেনিস্‌ খেলেন, মহিলাদের সহিত মধুরালাপ করেন এবং অধম আমাদেরই মত সামাজিক স্তুতিনিন্দায় বহুল পরিমাণে বিচলিত হইয়া থাকেন।

অতএব, এ স্থলে গবর্ণমেন্টের দ্বারা নির্ব্বাচনের অর্থ আর কিছুই নয়, একটি বা দুইটি বা অল্প সংখ্যক ইংরাজের দ্বারা নির্ব্বাচন।

কিন্তু আমরা পদে পদে প্রমাণ পাইয়াছি ভারতবর্ষীয় ইংরাজেরা নব্য শিক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রতি একান্ত অনুরক্ত নহেন। কারণ, নব্যরুচি অনুসারে ইঁহারা চশমা ব্যবহার করেন, দাড়ি রাখেন, ইংরাজি জুতা পরেন, এবং সে জুতা সহজে খুলিতে চাহেন না। তদ্ভিন্ন ইঁহাদের স্বাতন্ত্র্যপ্রিয়তা, ইঁহাদের ঔদ্ধত্য, ইঁহাদের বক্তৃতাশক্তি প্রভৃতি নানা কারণে তাঁহারা একান্ত উদ্‌বেজিত হইয়া আছেন। অতএব তাঁহাদের হস্তে নির্ব্বাচনের ভার থাকিলে এই শিক্ষিত দলের পক্ষে বড় আশার কারণ নাই। ইঁহাদের দর্প চূর্ণ করা তাঁহারা রাজনৈতিক কর্ত্তব্য জ্ঞান করেন। অতএব শিক্ষিত লোকেরা তাহাঁদের দ্বারে প্রার্থী হইয়া দাঁড়াইলে কেবল যে নিরাশ হইয়া ফিরিয়া আসিবেন তাহা নহে, উপরন্তু সাহেবের নিকট দুটো শ্রুতিপরুষ অথচ বাৎসল্যগর্ভ উপদেশ শুনিয়া এবং প্রবেশাধিকারের মূল্যস্বরূপ দ্বারীকে কিঞ্চিত দন্ড দিয়া আসিতে হইবে।

কিন্তু ইংরাজি শিক্ষা কিছু এমনি বিড়ম্বনা নহে যে কেবল শিক্ষিত ব্যক্তিরাই সকল প্রকার যোগ্যতা লাভে অক্ষম হইয়াছেন। অতএব শিক্ষিত ব্যক্তিদের প্রতি ভারতবর্ষীয় ইংরাজের এই-যে বিরাগ তাহা কেবল ব্যক্তিগত রুচিবিকার মাত্র, তাহা যুক্তিসঙ্গত ন্যায়সঙ্গত নহে।