ছন্দের মাত্রা
অমূল্যবাবু বলেন, এর প্রথম দুই কলায় চার চার আট এবং শেষের কলায় এক মাত্রার ছন্দ কৃত্রিম শুনতে হয়। বোধ হয় অখণ্ড শব্দকে খণ্ডিত করা হচ্ছে বলে তাঁর কাছেএটা কৃত্রিম ঠেকছে। কিন্তু, ছন্দের ঝোঁকে অখণ্ড শব্দকে দুভাগ করার দৃষ্টান্ত অনেক আছে। এরকম তর্কে বিশুদ্ধ হাঁ এবং না-এর দ্বন্দ্ব; কোনো পক্ষে কোনো যুক্তিপ্রয়োগের ফাঁক নেই। আমি বলছি, কৃত্রিম শোনায় না; তিনি বলছেন, শোনায়। আমি এখনো বলি, এই রকম কলাভাগে এই ছন্দে একটি নূতন নৃত্যভঙ্গি জেগে ওঠে, তার একটা রস আছে।

দশের বেশি মাত্রাভার বাংলা ছন্দ বহন করতে অক্ষম, এ কথা মানতে পারব না। নিম্নে বারো মাত্রার একটি শ্লোক দেওয়া গেল।

মেঘ ডাকে গম্ভীর গরজনে,

ছায়া নামে তমালের বনে বনে,

ঝিল্লি ঝনকে নীপবীথিকায়।

সরোবর উচ্ছল কূলে কূলে,

তটে তারি বেণুশাখা দুলে দুলে

মেতে ওঠে বর্ষণগীতিকায়।

শ্রোতারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, আবৃত্তিকালে পদান্তের পূর্বে কোনো যতিই দিই নি, অর্থাৎ বারো মাত্রা একটি ঘনিষ্ঠ গুচ্ছের মতোই হয়েছে। এই পদগুলিকে বারো মাত্রার পদ বলবার কোনো বাধা আছে বলে আমি কল্পনা করতে পারি নে। উল্লিখিত শ্লোকের ছন্দে বারো মাত্রা, প্রত্যেক পদে তিন কলা, প্রত্যেক কলায় চার মাত্রা। বারো মাত্রার পদকে চার কলায় বিভক্ত করে ত্রৈমাত্রিক করলে আর-এক ছন্দ দেখা দেবে। যথা–

শ্রাবণগগন, ঘোর ঘনঘটা,

তাপসী যামিনী এলায়েছে জটা,

দামিনী ঝলকে রহিয়া রহিয়া।

এ ছন্দ বাংলাভাষায় সুপরিচিত।

তমালবনে ঝরিছে বারিধারা,

তড়িৎ ছুটে আঁধারে দিশাহারা।

ছিঁড়িয়া ফেলে কিরণকিঙ্কিণী

আত্মঘাতী যেন সে পাগলিনী।

পঞ্চমাত্রাঘটিত এই বারোমাত্রাকেও কেন যে বারোমাত্রা বলে স্বীকার করব না, আমি বুঝতেই পারি নে।

কেবল নয় মাত্রার পদ বলার দ্বারা ছন্দের একটা সাধারণ পরিচয় দেওয়া হয়, সে পরিচয় বিশেষভাবে সম্পূর্ণ হয় না। আমার সাধারণ পরিচয়, আমি ভারতীয়; বিশেষ পরিচয়, আমি বাঙালি; আরও বিশেষ পরিচয়, আমি বিশেষ পরিবারের বিশেষ নামধারী মানুষ। নয় মাত্রার পদবিশিষ্ট ছন্দ সাধারণভাবে অনেক হতে পারে। আরো বিশেষ পরিচয় দাবি করলে, এর কলাসংখ্যা এবং সেই কলার মাত্রাসংখ্যার হিসাব দিতে হয়।

কোনো কোনো ছন্দে কলাবিভাগ করতে ভুল হবার আশঙ্কা আছে। যেমন– গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা। পয়ারের ১৪ মাত্রা থেকে এক মাত্রা হরণ করে এই ১৩ মাত্রার ছন্দ গঠিত। অর্থাৎ ‘গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরিষন’ এবং এই ছন্দটি বস্তুত এক, এমন মনে হতে পারে। আমি তা স্বীকার করি নে; তার সাক্ষী শুধু কান নয়, তালও বটে। এই দুটি ছন্দে তালের ঘা পড়েছে কী রকম