ব্যক্তি প্রসঙ্গ
একবার জমে উঠলে সেই ধারার অনুবর্তন করলে আর্টিস্টের আপদ থাকে না। কিন্তু যে আত্মবিদ্রোহী শিল্পী আপন তুলির অভ্যাসকে ক্ষণে ক্ষণে ভাঙতে থাকে, আর যাই হোক, হাটে-বাজারে তাকে বারে বারে ঠকতে হবে। তা হোক, বাজারে ঠকা ভালো, নিজেকে ঠকানো তো ভালো নয়। আমি নিশ্চিত জানি, নন্দলাল সেই নিজেকে ঠকাতে অবজ্ঞা করে, তাতে তাঁর লোকসান যদি হয় তো হোক। অমুক বই বা অমুক ছবি পর্যন্ত লেখক বা শিল্পীর উৎকর্ষের সীমা— বাজারে এমন জনরব মাঝে মাঝে ওঠে, অনেক সময়ে তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, লোকের অভ্যস্ত বরাদ্দে বিঘ্ন ঘটেছে। সাধারণের অভ্যাসের বাঁধা জোগানদার হবার লোভ সামলাতে না পারলে সেই লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। আর যাই হোক সেই পাপলোভের আশঙ্কা নন্দলালের একেবারেই নেই। তাঁর লেখনী নিজের অতীত কালকে ছাড়িয়ে চলবার যাত্রিণী। বিশ্বসৃষ্টির যাত্রাপথ তো সেই দিকেই, তার অভিসার অন্তহীনের আহ্বানে।

আর্টিস্টের স্বকীয় আভিজাত্যের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর চরিত্রে তাঁর জীবনে। আমরা বারংবার তার প্রমাণ পেয়ে থাকি নন্দলালের স্বভাবে। প্রথম দেখতে পাই আর্টের প্রতি তাঁর সম্পূর্ণ নির্লোভ নিষ্ঠা। যদি বিষয়বুদ্ধির দিকে তাঁর আকাঙ্ক্ষার দৌড় থাকত, তা হলে সেই পথে অবস্থার উন্নতি হবার সুযোগ তাঁর যথেষ্ট ছিল। প্রতিভার সাচ্চাদাম-যাচাইয়ের পরীক্ষক ইন্দ্রদেব শিল্প-সাধকদের তপস্যার সম্মুখে রজত নূপুরনিক্কণের মোহজাল বিস্তার করে থাকেন, সরস্বতীর প্রসাদস্পর্শ সেই লোভ থেকে রক্ষা করে, দেবী অর্থের বন্ধন থেকে উদ্ধার করে সার্থকতার মুক্তিবর দেন। সেই মুক্তিলোকে বিরাজ করেন নন্দলাল, তাঁর ভয় নেই।

তাঁর স্বাভাবিক আভিজাত্যের আর-একটি লক্ষণ দেখা যায়, সে তাঁর অবিচলিত ধৈর্য। বন্ধুর মুখের অন্যায় নিন্দাতেও তাঁর প্রসন্নতা ক্ষুণ্ন হয় নি তার দৃষ্টান্ত দেখেছি। যারা তাঁকে জানে এমনতরো ঘটনায় তারাই দুঃখ পেয়েছে, কিন্তু তিনি অতি সহজেই ক্ষমা করতে পেরেছেন। এতে তাঁর অন্তরের ঐশ্বর্য সপ্রমাণ করে। তাঁর মন গরীব নয়। তাঁর সমব্যবসায়ীর কারো প্রতি ঈর্ষার আভাসমাত্র তাঁর ব্যবহারে প্রকাশ পায় নি। যাকে যার দেয় সেটি চুকিয়ে দিতে গেলে নিজের যশে কম পড়বার আশঙ্কা কোনোদিন তাঁকে ছোটো হতে দেয় নি। নিজের সম্বন্ধে ও পরের সম্বন্ধে তিনি সত্য; নিজেকে ঠকান না ও পরকে বঞ্চিত করেন না। এর থেকে দেখতে পেয়েছি নিজের রচনায় যেমন, নিজের স্বভাবেও তিনি তেমনি শিল্পী, ক্ষুদ্রতার ত্রুটি স্বভাবতই কোথাও রাখতে চান না।

শিল্পী ও মানুষকে একত্র জড়িত করে আমি নন্দলালকে নিকটে দেখেছি। বুদ্ধি, হৃদয়, নৈপুণ্য অভিজ্ঞতা ও অন্তর্দৃষ্টির এরকম সমাবেশ অল্পই দেখা যায়। তাঁর ছাত্র, যারা তাঁর কাছে শিক্ষা পাচ্ছে, তারা এ কথা অনুভব করে এবং তাঁর বন্ধু যারা তাঁকে প্রত্যহ সংসারের ছোটো বড়ো নানা ব্যাপারে দেখতে পায় তারা তাঁর ঔদার্যে ও চিত্তের গভীরতায় তাঁর প্রতি আকৃষ্ট। নিজের ও তাঁদের হয়ে এই কথাটি জানাবার আকাঙ্ক্ষা আমার এই লেখায় প্রকাশ পেয়েছে। এরকম প্রশংসার তিনি কোনো অপেক্ষা করেন না, কিন্তু আমার নিজের মনে এর প্রেরণা অনুভব করি।

. খান আবদুল গফ্‌ফর খান

অল্পক্ষণের জন্যে আপনি আমাদের মধ্যে এসেছেন কিন্তু সেই সৌভাগ্যকে আমি অল্প বলে মনে করি নে। আমার নিবেদন এই যে আমার এ কথাকে আপনি অত্যুক্তি ব’লে মনে করবেন না যে আপনার দর্শন আমাদের হৃদয়ের মধ্যে নূতন শক্তি সঞ্চার করেছে। প্রেমের উপদেশ মুখে ব’লে ফল হয় না, যাঁরা প্রেমিক তাঁদের সঙ্গই প্রেমের স্পর্শমণি, তার স্পর্শে, আমাদের অন্তরে যেটুকু ভালোবাসা আছে তার মূল্য বেড়ে যায়।

অল্পক্ষণের জন্য আপনাকে আমরা পেয়েছি কিন্তু এই ঘটনাকে ক্ষণের মাপ দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। যে মহাপুরুষদের হৃদয় সকল মানুষের জন্য, সকল দেশই যাঁদের দেশ, তাঁরা যে-কালকে উপস্থিতমতো অধিকার করেন তাকে অতিক্রম করেন, তাঁরা সকল