প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
|
![]() |
দেশে যে-সকল মহৎ প্রতিষ্ঠানে মানুষই মুখ্য, কর্মব্যবস্থা গৌণ, মানুষের অভাব ঘটিলে তাহাদের প্রাণশক্তিতে আঘাত লাগে। শিবানন্দ স্বামীর মৃত্যুতে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আশ্রমে সেই দুর্যোগ ঘটিল। এখন যাঁরা বর্তমান আছেন, প্রাণ দিয়া মৃত্যুর ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব তাঁহাদেরই। অহমিকাবর্জিত পরস্পর ঘনিষ্ঠতার প্রয়োজন এখন আরও বাড়িয়া উঠিল। নহিলে শূন্য পূর্ণ হইবে না এবং সেই ছিদ্রপথে বিশ্লিষ্টতার আক্রমণ আশ্রমের অন্তরে প্রবেশ করিতে পারে, সেই আশঙ্কা অনুভব করিতেছি। মহাপুরুষের কীর্তি ও স্মৃতি রক্ষার মহৎভার যাঁহাদের উপরে তাঁহারা নিজেদের ভুলিয়া সাধনাকে অক্ষুণ্ন রাখিবার এক লক্ষ্যে সকলে সম্মিলিত হইবেন—শিবানন্দ স্বামী তাঁহার মৃত্যুর মধ্যে এই বাণী রাখিয়া গিয়াছেন। দোল পূর্ণিমা, ১৩৪০
স্পিনোজা ছিলেন তত্ত্বজ্ঞানী, তাঁর তত্ত্ববিচারকে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় থেকে স্বতন্ত্র করে দেখা যেতে পারে। কিন্তু যদি মিলিয়ে দেখা সম্ভব হয় তবে তাঁর রচনা আমাদের কাছে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। প্রথম বয়সেই সমাজ তাঁকে নির্মমভাবে ত্যাগ করেছে কিন্তু কঠিন দুঃখেও সত্যকে তিনি ত্যাগ করেন নি। সমস্ত জীবন সামান্য কয় পয়সায় তাঁর দিন চলত; ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই তাঁকে মোটা অঙ্কের পেনসন দেবার প্রস্তাব করেছিলেন, শর্ত ছিল এই যে তাঁর একটি বই রাজার নামে উৎসর্গ করতে হবে। স্পিনোজা রাজি হলেন না। তাঁর কোনো বন্ধু মৃত্যুকালে আপন সম্পত্তি তাঁকে উইল করে দেন, সে সম্পত্তি তিনি গ্রহণ না করে দাতার ভাইকে দিয়ে দেন। তিনি যে তত্ত্বঞ্চানী ছিলেন, আর তিনি যে মানুষ ছিলেন এ দুটোকে এক কোঠায় মিলিয়ে দেখলে তাঁর সত্য সাধনার যথার্থ স্বরূপটি পাওয়া যায়, বোঝা যায় কেবলমাত্র তার্কিক বুদ্ধি থেকে তার উদ্ভব নয়, তাঁর সম্পূর্ণ স্বভাব থেকে তার উপলব্ধি ও প্রকাশ।
শিল্পকলায় রসসাহিত্যে মানুষের স্বভাবের সঙ্গে মানুষের রচনার সম্বন্ধ বোধ করি আরো ঘনিষ্ঠ। সব সময়ে তাদের একত্র করে দেখবার সুযোগ পাই নে। যদি পাওয়া যায় তবে তাদের কর্মের অকৃত্রিম সত্যতা সম্বন্ধে আমাদের ধারণা স্পষ্ট হতে পারে। স্বভাবকবিকে স্বভাবশিল্পীকে কেবল যে আমরা দেখি তাদের লেখায়, তাদের হাতের কাজে তা নয়, দেখা যায় তাদের ব্যবহারে, তাদের দিনযাত্রায়, তাদের জীবনের প্রাত্যহিক ভাষায় ও ভঙ্গিতে।
চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসুর নাম আমাদের দেশের অনেকেরই জানা আছে। নিঃসন্দেহে আপন আপন রুচি মেজাজ শিক্ষা ও প্রথাগত অভ্যাস অনুসারে তাঁর ছবির বিচার অনেকে অনেক রকম করে থাকেন। এরকম ক্ষেত্রে মতের ঐক্য কখনো সত্য হতে পারে না, বস্তুত প্রতিকূলতাই অনেক সময়ে শ্রেষ্ঠতার প্রমাণরূপে দাঁড়ায়। কিন্তু নিকট থেকে নানা অবস্থায় মানুষটিকে ভালো করে জানবার সুযোগ আমি পেয়েছি। এই সুযোগে যে-মানুষটি ছবি আঁকেন তাঁকে সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা করেছি বলেই তাঁর ছবিকেও শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করতে পেরেছি। এই শ্রদ্ধায় যে-দৃষ্টিকে শক্তি দেয় সেই দৃষ্টি প্রত্যক্ষের গভীরে প্রবেশ করে।