ব্যক্তি প্রসঙ্গ
আমাদের দিয়ে থাকেন। পিয়র্সন তা করেননি—তিনি তাঁর আত্মাকেই দিয়েছিলেন আমাদের, এবং সেই উপলক্ষে সমস্ত মানুষকে, সমস্ত মানুষের দেবতাকে। আমি তাঁকে দেশ-বিদেশে নানা অবস্থায় দেখেছি—চীনে হোক জাপানে হোক অন্যত্র হোক যেখানেই তিনি দুঃখ বা অপমান দেখেছেন এবং এও অনুভব করেছেন যে, সেই দুঃখ অপমানের মূলে আছে তাঁর স্বজাতি—সেখানে তিনি মুহূর্তকালের জন্য এবং লেশমাত্র পরিমাণেও স্বদেশের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করেন নি। তিনি জানতেন যে ইংলণ্ডের সভ্যতা ও উন্নতি এশিয়া ও আফ্রিকার প্রাণ পোষণের উপর একান্ত নির্ভর করে, তার ধনসম্পদ প্রতাপের চারণক্ষেত্র এই-সকল মহাদেশে; তৎসত্ত্বেও তিনি তাঁর শুভচিন্তা ও সাধু লক্ষ্য বিশুদ্ধভাবে, নিঃস্বার্থভাবে ও সম্পূর্ণভাবে সর্বমানবের অভিমুখে প্রেরণ করেছিলেন।

কিন্তু যখন পিয়র্সনকে আমরা ভারতবন্ধু বলে আদর করি তখন তাঁর জীবনের এই বড়ো সত্যটিকে এক রকম করে চাপা দিয়ে রাখি। তাঁর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যেখানে আমাদের স্বাজাত্য অভিমানকে তৃপ্ত করে সেইখানেই তাঁকে যথার্থভাবে গ্রহণ করি ক্ষণকালের জন্যে চিন্তাও করি নি যে এই স্বাজাত্য অভিমানকে জলাঞ্জলি দিয়ে তবে তিনি আমাদের কাছে এসেছেন, এবং সেই মহিমাতেই তাঁর জীবন দীপ্যমান। যদি তাঁর এই সত্যকে আমরা শ্রদ্ধা না করি তবে তাঁর হাত থেকে দান গ্রহণ করবার মতো দীনতা আর কিছু হতেই পারে না। তাঁকে বহিষ্কৃত করে তাঁর দান গ্রহণ করায় তাঁর প্রতি ও নিজের প্রতি যে অশ্রদ্ধা করা হয় সেটা যেন আমরা অনুভব করতে পারি।

সেই বড়ো সত্যকে স্বীকার করবার জন্য বিশ্বভারতীর সাধনা। যাঁরা বিশ্বের জন্য তপস্যা করেছেন এখানে তাঁদের আসন পাতা হোক। আমরা ‘বন্দেমাতরম’ বলে জয়ধ্বনি করলে কেবল স্বদেশকে ক্ষুদ্র করা হবে, আমরা এই কার্পণ্যের দ্বারা বড়ো হতে পারব না। মানবপ্রেমের অর্ঘ্য হৃদয়ে বহন করে সমুদ্রপার থেকে যে বন্ধুরা আমাদের কাছে আসছেন তাঁদের জীবন বিশ্বভারতীর তপস্যার ভিতর দিয়ে এই কথাই ঘোষণা করছে যে, সকল মানুষের মধ্যে নিজের মনুষ্যত্বকে উপলব্ধি করা মানব সম্বন্ধে সত্যকে পাওয়া।

পিয়র্সন ভারতবর্ষে এসে শুধু যে এর দুঃখকষ্ট অপূর্ণতার মধ্যে একে সেবা করে গেছেন তাই নয় কিন্তু তিনি এখানকার জীবনযাত্রার প্রণালীকে স্বীকার করে নিয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে আনন্দে বলেছেন, আমি যা পেলুম তা খুব বড়ো জিনিস, আমি কৃতার্থ হলুম।

তা বলবার আসল কারণ এই যে তিনি আপনাকে দিতে গিয়েই বড়ো সম্পদ লাভ করেছেন। আমরা যখন কেবলমাত্র পেতে যাই তখন বড়োকে পাই নে, যখন নিতে যাই তখন ভূমাকে পাই। ভারতবর্ষের উপকার করব বলে যদি কেউ কোমর বেঁধে আসে তা হলে ভারতবর্ষকে যথার্থ জানতেই পারবে না, উপকার করবে কী! কারণ সেই রকম উপকারের দ্বারা ফল পেতে চায়—সে ফল তাদের মনের মতো। কিন্তু যারা মানবপ্রেমের টানে ভারতের কাছে আপনাকে দিতে চায় তারা সেই দেওয়ার দ্বারাই ভারতের সত্যকে জানতে পারে। তাদের প্রেম শুধু দেয় না, পায়। না পেলে দেওয়াই যায় না।

যাঁরা জীবনের ক্ষেত্রে সেবা করতে, আপনাকে দান করতে আসেন তাঁরা আবিষ্কার করেন যে তাঁরা যা দিচ্ছেন তার চেয়ে বড়ো জিনিস তাঁরা পেয়ে যাচ্ছেন। পিয়র্সন সাহেব তাই বলতেন যে—আমি যা পেয়েছি তার জন্য বড়ো কৃতজ্ঞ হলুম।

আমরা আশ্রমবাসীরা যেন সেই বন্ধুকে পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে পারি। এখানকার ছাত্র অধ্যাপক যাঁরা তাঁর বন্ধুত্বের ও প্রেমের আস্বাদ পেয়েছেন তাঁরাই জানেন যে কী পবিত্র দান তিনি চারি দিকে রেখে গেছেন। তিনি এখানকার সাঁওতালদের একমাত্র বন্ধু ছিলেন, নিজে তাদের ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের মধ্যে কাজ করেছেন। আজ সেই-সব সাঁওতালরাই জানে যে কী সম্পদ তিনি দিয়ে গেছেন। তিনি এই সাঁওতালদের আর আশ্রমের শিশুদের সেবা করতে গিয়ে যে মহাসম্পদ লাভ করেছেন তা অতি মহামূল্য, তা সস্তায় পাওয়া নয়। তিনি সমস্ত দান করে তবেই সমস্ত গ্রহণ করতে পেরেছেন, জীবনের পাত্রকে পূর্ণ করে নিয়ে গেছেন। তিনি তাঁর মহৎজীবনকে পরিপূর্ণ করে সেই দান গ্রহণ করেছেন। তাঁর জীবনের পাত্র তাতে ভরপুর হয়ে উপছে পড়েছে, তিনি তার আনন্দে অধীর হয়েছেন।