ব্যক্তি প্রসঙ্গ
অল্প বলে কিছু নেই, সত্যপ্রীতি ভূমাকেই জানে। সংসার সেই ভূমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়, মৃত্যু সেই ভূমার বিরুদ্ধে প্রমাণ দিতে থাকে, কিন্তু প্রেমের অন্তরতম অভিজ্ঞতা যেন আপনার সত্যে আপনি বিশ্বাস না হারায়।

আমাদের যে অতি প্রিয়, প্রিয়দর্শন ছাত্রটি এখানে এসেছিল—না-জানার অতলস্পর্শ অন্ধকার থেকে জানার জ্যোতির্ময় লোকে—এল তার জাগ্রত জীবন্ত ঔৎসুকপূর্ণ চিত্ত নিয়ে, আমাদের কাজকর্মে সুখে দুঃখে যোগ দিলে—আজ শুনছি সে নেই। কিন্তু যেই শুনলুম সে নেই, অমনি তার কত ছোটো ছোটো কথা বড়ো হয়ে উঠে আমাদের মনের সামনে দেখা দিলে। ক্লাসে যখন সে পড়ত, তখন সেই পড়ার সময়কার বিশেষ দিনের বিশেষ এক-একটি সামান্য ঘটনা, বিশেষ কথায় তার হাসি, বিশেষ প্রশ্নের উত্তরে তার উৎসাহ, এ-সব কথা এতদিন বিশেষভাবে মনে ছিল না, আজ মনে পড়ে গেল। তার পরে ছেলেদের আনন্দবাজারে যে-সব কৌতুকের উপকরণ সে জড়ো করেছিল, সে সমস্ত আজ বড়ো হয়ে মনে পড়েছে।

বড়োলোকের বড়োকীর্তি আমাদের স্মরণক্ষেত্রে আপনি জেগে উঠে। সেখানে কীর্তিটাই নিজের মূল্যে নিজেকে প্রকাশ করে। কিন্তু এই বালকের যে-সব কথা আমাদের মনে পড়ছে, তাদের তো নিজের কোনো নিরপেক্ষ মূল্য নেই। তারা যে বড়ো হয়ে উঠেছে সে কেবল একটি মূল সত্যের যোগে। সেই সত্যটি হচ্ছে সেই বালকটি স্বয়ং। পূর্বেই বলেছি, সত্য ভূমা। অর্থাৎ বাইরের মাপে, কোনো প্রয়োজনের পরিমাণে, তার মূল্য নয়— তার মূল্য আপনাতেই। সেই মূল্যেই তার ছোটোও ছোটো নয়, তার সামান্য চিহ্নও তুচ্ছ নয়— এই কথা ধরা পড়ে প্রেমের কাছে।

তোমাদের সঙ্গে সে যে হেসেছিল, খেলেছিল, একসঙ্গে পড়েছিল, এ কি কম কথা! তার সেই হাসি খেলা, তোমাদের সঙ্গে তার সেই পড়াশোনা, মানুষের চিরউৎসারিত সৌহার্দ্য-ধারারই অঙ্গ, সৃষ্টির মধ্যে যে অমৃত আছে, সেই অমৃতেরই অংশ। আমাদের এখানে তোমাদের যে প্রাণপ্রবাহ, যে আনন্দপ্রবাহ বয়ে চলেছে, তার মধ্যে সেও তার জীবনের গতি কিছু দিয়ে গেল,এখানকার সৃষ্টির মধ্যে সেও আপনাকে কিছু রেখে গেল। এখানে দিনের সঙ্গে দিন, কাজের সঙ্গে কাজ, ভাবের সঙ্গে ভাব, প্রতিদিন যে গাঁথা পড়ছে, নানা রঙে নানা সুতোয় মিলে এখানে একটি রচনাকার্য চলছে। সেইজন্যে এখানে আমাদের সকলেরই জীবনের ছোটো বড়ো নানা টুকরো ধরা পড়ে যাচ্ছে; সেই বালকেরও জীবনের যে অংশ এখানে পড়েছে, সমস্ত আশ্রমের সেইটুকু রয়ে গেল, এই কথাটি আজ তার শ্রাদ্ধ-দিনে মনে করতে হবে।

তা ছাড়া তার জীবনের কীর্তিও কিছু আছে এখানে। ভুবনডাঙার গরীবদের জন্যে সে এখানে যে নৈশবিদ্যালয় স্থাপন করে গেছে, তার কথা তোমরা সবাই জান। চাঁদা সংগ্রহ করে আমরা অনেক সময় মঙ্গল অনুষ্ঠানের চেষ্টা করে থাকি। কিন্তু তার চেয়ে বড়ো হচ্ছে নিজের সাধ্য দ্বারা, নিজের উপার্জনের অর্থ দ্বারা কাজ করা। নৈশবিদ্যালয় স্থাপন সম্বন্ধে মুলু তাই করেছে। সে পুরোনো কাগজ নিজে বোলপুরে বয়ে নিয়ে বিক্রি করে এই বিদ্যালয়ের ব্যয় নির্বাহ করত। সে নিজে তাদের শেখাত, তাদের আমোদ দিত। এ সম্বন্ধে আশ্রমের কর্তৃপক্ষের কোনো সাহায্য সে নেয় নি। এই অনুষ্ঠানটি কেবল যে তার ইচ্ছা থেকে প্রসূত, তা নয়, তার নিজের ত্যাগের দ্বারা গঠিত। তার এই কাজটি, এবং তার চেয়ে বড়ো, তার এই উৎসাহটি, আশ্রমে রয়ে গেল।

পূর্বে বলেছি, অপরিসীম অজানা থেকে জানার মধ্যে মানুষ আসবামাত্রই সেই না-জানার শূন্যতা এক নিমেষে চলে যায়—সেই না-জানার মহা গহ্বর সত্যের দ্বারা নিমেষে পূর্ণ হয়ে যায়। অন্তরের মধ্যে বুঝতে পারি, আমাদের গোচরতা এবং অগোচরতা, দুইকেই ব্যাপ্ত করে সত্যের লীলা চলছে। অগোচরতা সত্যের বিলোপ নয়। পাবার বেলায় এই যে আমাদের অনুভূতি, ছাড়বার বেলায় একে আমরা ভুলব কেন? ঢেউয়ের চূড়াটি নীচের থেকে উপরে যখন উঠে পড়ল, তখন সত্যের বার্তা পেয়েছি; ঢেউয়ের চূড়াটি যখন উপর থেকে নীচে নেমে পড়ল, তখন সত্যের সেই বার্তাটিকে কেন বিশ্বাস করব না? এক-সময়ে সত্য আমাদের গোচরে এসে ‘আমি আছি’ এই কথাটি আমাদের মনের মধ্যে লিখে দিল—তার স্বাক্ষর রইল; এখন সে যদি অগোচরে যায়, অন্তরের মধ্যে তার এই দলিল মিথ্যে