ব্যক্তি প্রসঙ্গ
দ্বার উদ্‌ঘাটন করে, তাহা সে-ই জানে। আমরা হিসাব করিয়া, সুবিধা বিচার করিয়া তাহাকে হুকুম করিলেই যে সে হুকুম মানে, তাহা নহে। সে কী বুঝিয়া আপনার নিমন্ত্রণপত্র বিলি করে, তাহা আমরা ভালো করিয়া বুঝিতেই পারি না।

এইজন্য বেশি বয়সের বন্ধুত্বের মধ্যে একটি অভাবনীয় রহস্য দেখিতে পাই। যে বয়সে আমাদের পুরাতন অনেক জিনিস ঝরিয়া যাইতে থাকে এবং নূতন কোনো জিনিসকে আমরা নির্বিচারে গ্রহণ করিতে পারি না, সেই বয়সে কেমন করিয়া হঠাৎ একদা একরাত্রির অতিথি দেখিতে দেখিতে চিরদিনের আত্মীয় হইয়া উঠে, তাহা বুঝিয়া উঠা যায় না।

মনে হয়, আমাদের অন্তরলক্ষ্মী—যিনি আমাদের জীবনযজ্ঞ নির্বাহ করিবার ভার লইয়াছেন, তিনিই বুঝিতে পারেন, এই যজ্ঞে কাহাকে তাঁহার কী প্রয়োজন, কে না আসিলে তাঁহার উৎসব সম্পূর্ণ হইবে না। তিনি কাহার ললাটে কী লক্ষণ দেখিতে পান—তাহাকে আপনার বলিয়া চিনিতে পারেন, তাহার রহস্য আমাদের কাছে ভেদ করেন নাই।

যেদিন মোহিতচন্দ্র প্রথম আমার কাছে আসিয়াছিলেন, সেদিন শিক্ষাসম্বন্ধে তাঁহার সঙ্গে আমার আলোচনা হইয়াছিল। আমি শহর হইতে দূরে বোলপুরের নিভৃত প্রান্তরে এক বিদ্যালয়স্থাপনের ব্যবস্থা করিয়াছিলাম। এই বিদ্যালয়সম্বন্ধে আমার মনে যে একটি আদর্শ ছিল, তাহাই তাঁহার সম্মুখে ধরিবার চেষ্টা করিলাম।

তাহার পরে তিনি অবকাশ বা উৎসব উপলক্ষে মাঝে মাঝে বোলপুরে আসিতে লাগিলেন। ভারতবর্ষ বহুকাল ধরিয়া তাহার তীব্র-আলোক-দীপ্ত এই আকাশের নীচে দূরদিগন্তব্যাপী প্রান্তরের মধ্যে একাকী বসিয়া কী ধ্যান করিয়াছে, কী কথা বলিয়াছে, কী ব্যবস্থা করিয়াছে, কী পরিণামের জন্য সে অপেক্ষা করিতেছে, বিধাতা তাহার সম্মুখে কী সমস্যা আনিয়া উপস্থিত করিয়াছেন, এই কথা লইয়া কতদিন গোধূলির ধূসর আলোকে বোলপুরের শস্যহীন জনশূন্য প্রান্তরের প্রান্তবর্তী রক্তবর্ণ সুদীর্ঘ পথের উপর দিয়া আমরা দুইজনে পদচারণ করিয়াছি। আমি এই-সকল নানা কথা ভাবের দিক দিয়াই ভাবিয়াছি; আমি পণ্ডিত নহি; বিচিত্র মানবসংসারের বৃত্তান্ত সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ। কিন্তু রাজপথ যেমন সকল যাত্রীরই যাতায়াত অনায়াসে সহ্য করে, সেইরূপ মোহিতচন্দ্রের যুক্তিশাস্ত্রে সুপরিণত সর্বসহিষ্ণু পাণ্ডিত্য আমার নিঃসহায় ভাবগুলির গতিবিধিকে অকালে তর্কের দ্বারা রোধ করিত না—তাহারা কোন্‌ পর্যন্ত গিয়া পৌঁছে, তাহা অবধানপূর্বক লক্ষ্য করিতে চেষ্টা করিত। যুক্তি-নামক সংহত-আলোকের লণ্ঠন এবং কল্পনা-নামক জ্যোতিষ্কের ব্যাপকদীপ্তি, দু-ই তিনি ব্যবহারে লাগাইতেন; সেইজন্য অন্যে যাহা বলিত, নিজের মধ্য হইতে তাহা পূরণ করিয়া লইবার শক্তি তাঁহার ছিল; সেইজন্য পাণ্ডিত্যের কঠিন বেষ্টনে তাঁহার মন সংকীর্ণ ছিল না, কল্পনাযোগে সর্বত্র তাঁহার প্রবেশাধিকার তিনি রক্ষা করিয়াছিলেন।

মনের আদর্শের সঙ্গে বাস্তব আয়োজনের প্রভেদ অনেক। তীক্ষ্ণদৃষ্টির সঙ্গে উদার কল্পনাশক্তি যাঁহাদের আছে, তাঁহারা প্রথম উদ্‌যোগের অনিবার্য ছোটোখাটো ত্রুটিকে সংকীর্ণ অধৈর্যদ্বারা বড়ো করিয়া তুলিয়া সমগ্রকে বিকৃত করিয়া দেখেন না। আমার নূতনস্থাপিত বিদ্যালয়ের সমস্ত দুর্বলতা-বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করিয়া মোহিতচন্দ্র ইহার অনতিগোচর সম্পূর্ণতাকে উপলব্ধি করিতে পারিয়াছিলেন। তখন আমার পক্ষে এমন সহায়তা আর কিছুই হইতে পারিত না। যাহা আমার প্রয়াসের মধ্যে আছে, তাহা আর-একজনের উপলব্ধির নিকট সত্য হইয়া উঠিয়াছে, উদ্‌যোগকর্তার পক্ষে এমন বল—এমন আনন্দ আর কিছুই হইতে পারে না। বিশেষত তখন কেবল আমার দুই-একজন-মাত্র সহায়কারী সুহৃৎ ছিলেন; তখন অশ্রদ্ধা, অবজ্ঞা এবং বিঘ্নে আমার এই কর্মের ভার আমার পক্ষে অত্যন্ত দুর্বহ হইয়া উঠিয়াছিল।

একদিন কলিকাতা হইতে চিঠি পাইলাম, আমার কাছে তাঁহার একটু বিশেষ প্রয়োজন আছে, তিনি বোলপুরে আসিতে চান। সন্ধ্যার গাড়িতে আসিলেন। আহারে বসিবার পূর্বে আমাকে কোণে ডাকিয়া লইয়া কাজের কথাটা শেষ করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। নিভৃতে আসিয়া কুণ্ঠিতভাবে কহিলেন—‘আমি মনে করিয়াছিলাম, এবারে পরীক্ষকের পারিশ্রমিক যাহা পাইব, তাহা নিজে রাখিব না।