দিলীপকুমার রায়কে লিখিত

১৮ অক্টোবর ১৯২৯

গীতাঞ্জলির কয়েকটি গানের ছন্দ সম্বন্ধে কৈফিয়ত চেয়েছ। গোড়াতেই বলে রাখা দরকার–গীতাঞ্জলিতে এমন অনেক কবিতা আছে যার ছন্দোরক্ষার বরাত দেওয়া হয়েছে গানের সুরের ‘পরে। অতএব, যে পাঠকের ছন্দের কান আছে তিনি গানের খাতিরে এর মাত্রা কম-বেশি নিজেই দুরস্ত করে নিয়ে পড়তে পারেন, যাঁর নেই তাঁকে ধৈর্য অবলম্বন করতে হবে।

১। ‘নব নব রূপে এসো প্রাণে’–এই গানের অন্তিম পদগুলির কেবল অন্তিম দুটি অক্ষরের দীর্ঘ হ্রস্ব স্বরের সম্মান স্বীকৃত হয়েছে। যথা ‘প্রাণে’ ‘গানে’ ইত্যাদি। একটিমাত্র পদে তার ব্যতিক্রম আছে। ‘এসো দুঃখে সুখে এসো মর্মে’–এখানে ‘সুখে’র একার’কে অবাঙালি রীতিতে দীর্ঘ করা হয়েছে। ‘সৌখ্যে’ কথাটা দিলে বলবার কিছু থাকত না, তবু সেটাতে রাজি হই নি। মানুষ চাপা দেওয়ার চেয়ে মোটর ভাঙা ভালো।

২। ‘অমল ধবল পা–লে লেগেছে মন্দ-মধুর হাওয়া’–এ গানে গানই মুখ্য, কাব্য গৌণ। অতএব তালকে সেলাম ঠুকে ছন্দকে পিছিয়ে থাকতে হল। যদি বলো পাঠকেরা তো শ্রোতা নয়, তারা মাফ করবে কেন। হয়তো করবে না–কবি জোড়হাত করে বলবে, ‘তাল-দ্বারা ছন্দ রাখিলাম, ত্রুটি মার্জনা করিবেন।’

৩। ৩৪ নম্বরটাও গান।১ তবুও এর সম্বন্ধে বিশেষ বক্তব্য হচ্ছে এই যে, যে ছন্দগুলি বাংলার প্রাকৃত ছন্দ, অক্ষর গণনা করে তাদের মাত্রা নয়।...

৪। ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা’–এই গানের ছন্দ তুমি কী নিয়মে পড় আমি ঠিক বুঝতে পারছি নে। ‘দেবতা শব্দের পরে একটা দীর্ঘ যতি আছে, সেটা কি রাখ না? যদি সেই যতিকে মান্য করে থাক তা হলে দেখবে ‘দেবতা’ এবং ‘খোলো দ্বার’ মাত্রায় অসমান হয় নি। এ-সব ধ্বনিগত তর্ক মোকাবিলায় মীমাংসা করাই সহজ। লিখিত বাক্যের দ্বারা এর শেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব হবে কিনা জানি নে। ছাপাখানা-শাসিত সাহিত্যে ছন্দোবিলাসী কবির এই এক মুশকিল–নিজের কণ্ঠ স্তব্ধ, পরের কণ্ঠের করুণার উপর নির্ভর। সেইজন্যেই আমাকে সম্প্রতি এমন কথা শুনতে হচ্ছে যে, আমি ছন্দ ভেঙে থাকি... আকাশের দিকে চেয়ে বলি—‘চতুরানন্‌, কোন্‌ কানওয়ালাদের’ পরে এক বিচারের ভার।’

৫। ‘আজি গন্ধবিধুর সমীরণে’ –কবিতাটি সহজ নিয়মেই পড়া উচিত। অবশ্য, এর পঠিত ছন্দে ও গীত ছন্দে প্রভেদ আছে।

৬। ‘জনগণমনঅধিনায়ক’ গানটায় যে মাত্রাধিক্যের কথা বলেছ সেটা অন্যায় বল নি। ঐ বাহুল্যের জন্যে ‘পঞ্জাব’ শব্দের প্রথম সিলেব্‌লটাকে দ্বিতীয় পদের গেটের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখি-
পন্‌। জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা ইত্যাদি।

‘পঞ্জাব’কে ‘পঞ্জব’ করে নামটার আকার খর্ব করতে সাহস হয় নি, ওটা দীর্ঘকায়াদের দেশ। ছন্দের অতিরিক্ত অংশের জন্যে একটু তফাতে আসন পেতে দেওয়া রীতি বা গীতি বিরুদ্ধ নয়।

১ – ‘আমার মিলন লাগি তুমি আসছ কবে থেকে’।