দিলীপকুমার রায়কে লিখিত
করে, তার সঙ্গে তর্ক কোরো না; শ্রেণীর সে উপাসক, শাস্ত্রের সে বুলি-বাহক, পৃথিবীর নানা বিপদের মধ্যে সেও এক বিশেষজাতীয়–কলাবিভাগে সে ফাসিস্‌ট্‌।

৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৮

মত বদলিয়েছি। জীবনস্মৃতি অনেক কাল পূর্বের লেখা। তার পরে বয়সও এগিয়ে চলেছে, অভিজ্ঞতাও। বৃহৎ জগতের চিন্তাধারা ও কর্মচক্র যেখানে চলছে, সেখানকার পরিচয়ও প্রশস্ততর হয়েছে। দেখেছি চিত্ত যেখানে প্রাণবান্‌ সেখানে সে জ্ঞানলোকে ভাবলোকে ও কর্মলোকে নিত্যনূতন প্রবর্তনার ভিতর দিয়ে প্রমাণ করছে যে, মানুষ সৃষ্টিকর্তা, কীটপতঙ্গের মতো একই শিল্পপ্যাটার্নের পুনরাবৃত্তি করছে না। আমার মনে আজ আর সন্দেহমাত্র নেই যে, কলুর বলদের মতো চোখে ঠুলি দিয়ে বাঁধা গণ্ডির মধ্যে নিরন্তর ঘুরতে থাকা সংগীতের সাহিত্যের কিংবা কোনো ললিতকলার চরম সদগতি নয়। হিন্দুস্থানী কালোয়াতের কণ্ঠব্যায়ামের তারিফ করতে রাজি আছি, এমন-কি তার রসভোগ থেকেও বঞ্চিত হতে চাই নে। কিন্তু, সেই রস চিত্তকে যদি মাদকতায় অভিভূত করে রাখে, অগ্রগামী কালের নব নব সৃষ্টিবৈচিত্র্যের পিছনে আমাদের বিহ্বলভাবে কাত করে রেখে দেয়, খাঁচার পাখির মতো যে বুলি শিখেছি তাই কেবলই আউড়িয়ে যাই এবং অবিকল আউড়িয়ে যাবার জন্যে বাহবা দাবি করি, তা হলে এই নকলনবিশি-বিধানকে সেলাম করে থাকব তার থেকে দূরে–নূতন সাধনার পথে খুঁড়িয়ে চলব সেও ভালো, কিন্তু হাজার বছর আগেকার রাস্তায় শিকল-বাধা শাগ্‌রেদি করতে পারব না। ভুল ভ্রান্তি অসম্পূর্ণতা সমস্তর ভিতর দিয়ে নবযুগবিধাতার ডাক শুনে চলতে থাকব নবসৃষ্টির কামনা নিয়ে। বাঁধা মতের প্রবীণদের কাছে গাল খাব–জীবনে তা অনেকবার খেয়েছি–কিন্তু আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে আমি কিছুতেই মানব না যে, আমি ভূতকালের ভূতে-পাওয়া মানুষ। আজ য়ুরোপীয় গুণীমণ্ডলীর মধ্যে এমন কেউ নেই যে বলে না যে, অজন্তার ছবি শ্রেষ্ঠ ছবি, কিন্তু তাঁদের মধ্যে এমন বেওকুফ কেই নেই যে ঐ অজন্তার ছবির উপর কেবল দাগা বুলিয়ে যাওয়াকেই শিল্পসাধনার চরম বলে মানে। তানসেনকে সেলাম করে বলব, ‘ওস্তাদজি, তোমার যে পথ আমারও সেই পথ।’অর্থাৎ, নবসৃষ্টির পথ। বাংলাদেশ একদিন সংগীতে গণ্ডিভাঙা নবজীবনের পথে চলেছিল। তার পদাবলী তার গীতকলাকে জাগিয়ে তুলেছিল দাসী করে নয়, সঙ্গিনী করে, তার গৌরব রক্ষা করে। সেই বাংলাদেশে আজ নতুন যুগের যখন ডাক পড়ল তখন সে হিন্দুস্থানী অন্তঃপুরে প্রাচীরের আড়ালে কুলরক্ষা করতে পারবে না–তখন সে জটিলার শাসন উপেক্ষা করে যুগলমিলনের পথে চরম সার্থকতা লাভ করবে। এ নিয়ে নিন্দে জাগবে, কিন্তু লজ্জা করলে চলবে না।

মত বদলিয়েছি। কতবার বদলিয়েছি তার ঠিক নেই। সৃষ্টিকর্তা যদি বার বার মত না বদলাতেন তা হলে আজকের দিনের সংগীতসভা ডাইনসরের ধ্রুপদী গর্জনে মুখরিত হত এবং সেখানে চতুর্দন্ত ম্যামথের চতুষ্পদী নৃত্য এমন ভীষণ হত যে যারা আজ নৃত্যকলায় পালোয়ানির পক্ষপাতী তারাও দিত দৌড়। শেষ দিন পর্যন্ত যদি আমার মত বদলাবার শক্তি অকুণ্ঠিত থাকে তা হলে বুঝব এখনো বাঁচবার আশা আছে। নইলে গঙ্গাযাত্রার আয়োজন কর্তব্য। আমাদের দেশে সেই শান-বাঁধানো ঘাটেই লোকসংখ্যা সব চেয়ে বেশি।