বাংলা কথ্যভাষা

বাংলা শব্দতত্ত্ব আলোচনা করিতে হইলে বাংলা দেশের ভিন্ন ভিন্ন জেলায় প্রচলিত উচ্চারণগুলির তুলনা আবশ্যক। অনেক বাংলা শব্দের মূল অনুসন্ধান করিতে গিয়া কৃতকার্য হওয়া যায় না। বাংলার ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে উচ্চারিত শব্দগুলি মিলাইয়া দেখিলে সেই মূল ধরিতে পারা সহজ হইতে পারে। তাহা ছাড়া উচ্চারণতত্ত্বটি শব্দতত্ত্বের একটি প্রধান অঙ্গ। স্বর ও ব্যঞ্জনের ধ্বনিগুলির কী নিয়মে বিকার ঘটে তাহা ভাষাতত্ত্বের বিচার্য। এজন্যও ভিন্ন জেলার উচ্চারণের তুলনা আবশ্যক। বাংলা দেশের প্রায় সকল জেলা হইতেই আমাদের আশ্রমে ছাত্রসমাগম হইয়াছে। তাঁহাদের সাহায্যে বাংলা ধাতুরূপ ও শব্দরূপের তুলনা-তালিকা আমরা বাহির করিতে চাই। নীচে আমরা যে তালিকা দিতেছি তাহার অবলম্বন কলিকাতা বিভাগের বাংলা। পাঠকগণ ইহা অনুসরণ করিয়া নিজ নিজ প্রদেশের উচ্চারণ-অনুযায়ী শব্দতালিকা পাঠাইলে আমাদের উপকার হইবে।

কলিকাতা বিভাগের শব্দের উচ্চারণ সম্বন্ধে দুই-একটা কথা বলা আবশ্যক। যখন ‘বালক’ পত্র প্রকাশ করিতাম সে অনেক দিনের কথা। তখন সেই পত্রে বাংলা শব্দোচ্চারণের কতকগুলি নিয়ম লইয়া আলোচনা করিয়াছিলাম। আমার সেই আলোচিত উচ্চারণপদ্ধতি কলিকাতা বিভাগের। স্থলবিশেষে বাংলায় অকারের উচ্চারণ ওকারঘেঁষা হইয়া যায় ইহা আমার বিচারের বিষয় ছিল। ‘করা’ শব্দের ক্‌-সংলগ্ন অকারের উচ্চারণ এবং ‘করি’ শব্দের ক্‌-সংলগ্ন অকারের উচ্চারণ তুলনা করিলে আমার কথা স্পষ্ট হইবে—এ উচ্চারণ কলিকাতা বিভাগের সে কথা পূর্বেই বলিয়াছি। কলিকাতার উচ্চারণে ‘মসী’ শব্দস্থিত অকার এবং ‘দোষী’ শব্দস্থিত ওকারের উচ্চারণ একই। ‘বোল্‌তা’ এবং ‘বলব’ও সেইরূপ। বাংলা উচ্চারণে কোনো ওকার দীর্ঘ কোনো ওকার হ্রস্ব; হসন্ত শব্দের পূর্ববর্তী ওকার দীর্ঘ এবং স্বরান্ত শব্দের পূর্ববর্তী ওকার হ্রস্ব। ‘ঘোর’ এবং ‘ঘোড়া’ শব্দের উচ্চারণ-পার্থক্য লক্ষ্য করিলেই ইহা ধরা পড়িবে। কিন্তু যেহেতু বাংলায় দীর্ঘ-ও হ্রস্ব-ও একই ওকার চিহ্নের দ্বারা ব্যক্ত হইয়া থাকে সেইজন্য নিম্নের তালিকায় এইসকল সূক্ষ্ম প্রভেদগুলি বিশেষ চিহ্ন দ্বারা নির্দেশ করিতে চেষ্টা করিলাম না।

আমরা প্রথমে ক্রিয়াপদের তালিকা দিতেছি। বাংলায় একবচনে ও বহুবচনে ক্রিয়ার প্রকৃতির কোনো পার্থক্য ঘটে না বলিয়াই জানি, এইজন্য নীচের তালিকায় বহুবচনের উল্লেখ নাই। যদি কোনো জেলায় বহুবচনের বিশেষ রূপ থাকে তবে তাহা নির্দেশ করা আবশ্যক।

এইখানে হসন্ত উচ্চারণ সম্বন্ধে একটা কথা বলা দরকার। বাংলায় সাধারণত শব্দের শেষবর্ণস্থিত অকারের উচ্চারণ হয় না। যেখানে উচ্চারণ হয় সেখানে তাহা ওকারের মতো হইয়া যায়। যেমন ‘বন’, ‘মন’, এ শব্দগুলি হসন্ত। ‘ঘন’ শব্দটি হসন্ত নহে। কিন্তু উচ্চারণ হিসাবে লিখিতে হইলে লেখা উচিত, ঘনো। ‘কত’=কতো। ‘বড়’=বড়ো। ‘ছোট’=ছোটো। প্রসঙ্গক্রমে বলিয়া রাখি বাংলায় দুই অক্ষরের বিশেষণমাত্রই এইরূপ স্বরান্ত। বাংলায় হসন্তের আর-একটি নিয়ম আছে। বাংলায় যে অসংযুক্ত শব্দের পূর্বে স্বরবর্ণ ও পরে ব্যঞ্জনবর্ণ আছে সে শব্দ নিজের অকার বর্জন করে। ‘পাগল্‌’ শব্দের গ আপন অকার রক্ষা করে যেহেতু পরবর্তী ল-এ কোনো স্বর নাই। কিন্তু ‘পাগ্‌লা’ বা ‘পাগ্‌লী’ শব্দে গ অকার বর্জন করে। এইরূপ—আপন—আপ্‌নি, ঘটক—ঘট্‌কী, গরম—গর্‌মি ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, অনতিপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দে এ নিয়ম খাটে না, যেমন ঘোটক—ঘোটকী। এইপ্রকার হসন্ত সম্বন্ধে বাংলায় সাধারণ নিয়মের যখন প্রায় ব্যতিক্রম দেখা যায় না তখন আমরা এরূপ স্থলে বিশেষভাবে হসন্তচিহ্ন দিব না—যেমন ‘করেন্‌’ না লিখিয়া ‘করেন’ লিখিব, ‘কোর্‌চেন’ না লিখিয়া ‘কোরচেন’ লিখিব।

আমি কোরি         তুই কোরিস         আমি কোরচি         তুই কোরচিস