বাংলা ব্যাকরণের তির্যকরূপ

কিন্তু ‘আছে’ ক্রিয়ার স্থলে কর্তৃপদে একার বসে না, এ নিয়মের ব্যতিক্রম এখনো ভাবিয়া পাই নাই।

আসা এবং যাওয়া ক্রিয়াটি যদিও সাধারণত সচেষ্টক, তবু তাহাদের সম্বন্ধে পূর্বোক্ত নিয়মটি ভালোরূপে খাটে না। আমরা বলি ‘সাপে কামড়ায়’ বা ‘কুকুরে আঁচড়ায়’ কিন্তু ‘সাপে আসে’ বা ‘কুকুরে যায়’ বলি না। অথচ ‘যাতায়াত করা’ ক্রিয়ার অর্থ যদিচ যাওয়া আসা করা, সেখানে এ নিয়মের ব্যতিক্রম নাই। আমরা বলি এ পথ দিয়ে মানুষে যাতায়াত করে, বা ‘যাওয়া আসা করে’ বা ‘আনাগোনা করে’। কারণ, ‘করে’ ক্রিয়াযোগে আসা যাওয়াটা নিশ্চিতভাবেই সচেষ্টক হইয়াছে। ‘খেতে যায়’ বা ‘খেতে আসে’ প্রভৃতি সংযুক্ত ক্রিয়াপদেও এ নিয়ম অব্যাহত থাকে—যেমন, ‘এই পথ দিয়ে বাঘে জল খেতে যায়’।

‘সকল’ ও ‘সব’ শব্দ সচেষ্টক অচেষ্টক উভয় শ্রেণীর ক্রিয়া-সহযোগেই তির্যক্‌রূপ লাভ করে। যথা, এ ঘরে সকলেই আছেন বা সবাই আছে।

ইহার কারণ এই যে, ‘সকল’ ও ‘সব’ শব্দ দুটি বিশেষণপদ। ইহারা তির্যক্‌রূপ ধারণ করিলে তবেই বিশেষ্যপদ হয়। ‘সকল’ ও ‘সব’ শব্দটি হয় বিশেষণ, নয় অন্য শব্দের যোগে বহুবচনের চিহ্ন—কিন্তু ‘সকলে’ বা ‘সবে’ বিশেষ্য। কথিত বাংলায় ‘সব’ শব্দটি বিশেষ্যরূপ গ্রহণকালে দ্বিগুণভাবে তির্যক্‌রূপ প্রাপ্ত হয়—প্রথমত ‘সব’ হইতে হয় ‘সবা’ তাহার পরে পুনশ্চ তাহাতে এ যোগ হইয়া হয় ‘সবাএ’। এই ‘সবাএ’ শব্দকে আমরা ‘সবাই’ উচ্চারণ করিয়া থাকি।

‘জন’ শব্দ ‘সব’ শব্দের ন্যায়। বাংলায় সাধারণত ‘জন’ শব্দ বিশেষণরূপেই ব্যবহৃত হয়। একজন লোক, দুজন মানুষ ইত্যাদি। বস্তুত মানুষের পূর্বে সংখ্যা যোগ করিবার সময় আমরা তাহার সঙ্গে ‘জন’ শব্দ যোজনা করিয়া দিই। পাঁচ মানুষ কখনোই বলি না, পাঁচজন মানুষ বলি। কিন্তু এই ‘জন’ শব্দকে যদি বিশেষ্য করিতে হয় তবে ইহাকে তির্যক্‌রূপ দিয়া থাকি। দুজনে, পাঁচজনে ইত্যাদি। ‘সবাএ’ শব্দের ন্যায় ‘জনাএ’ শব্দ বাংলায় প্রচলিত আছে—এক্ষণে ইহা ‘জনায়’ রূপে লিখিত হয়।

বাংলায় ‘অনেক’ শব্দটি বিশেষণ। ইহাও বিশেষ্যরূপ গ্রহণকালে ‘অনেকে’ হয়। সর্বত্রই এ নিয়ম খাটে। ‘কালোএ’ (কালোয়) যার মন ভুলেছে ‘শাদাএ’ (শাদায়) তার কি করবে। এখানে কালো ও শাদা বিশেষণপদ তির্যক্‌রূপ ধরিয়া বিশেষ্য হইয়াছে। ‘অপর’ ‘অন্য’ শব্দ বিশেষণ কিন্তু ‘অপরে’ ‘অন্যে’ বিশেষ্য। ‘দশ’ শব্দ বিশেষণ, ‘দশে’ বিশেষ্য (দশে যা বলে)।

নামসংজ্ঞা সম্বন্ধে এ-প্রকার তির্যক্‌রূপ ব্যবহার হয় না—কখনো বলি না, ‘যাদবে ভাত খাচ্চে’। তাহার কারণ পূর্বেই নির্দেশ করা হইয়াছে, বিশেষ নাম কখনো সামান্য বিশেষ্যপদ হইতে পারে না। বাংলায় একটি প্রবাদবাক্য আছে ‘রামে মারলেও মরব রাবণে মারলেও মরব।’ বস্তুত এখানে ‘রাম’ ও রাবণ’ সামান্য বিশেষ্যপদ-এখানে উক্ত দুই শব্দের দ্বারা দুই প্রতিপক্ষকে বুঝাইতেছে। কোনো বিশেষ রাম-রাবণকে বুঝাইতেছে না।

তির্যক্‌রূপের মধ্যে প্রায়ই একটি সমষ্টিবাচকতা থাকে। যথা ‘আত্মীয়ে তাকে ভাত দেয় না।’ এখানে আত্মীয় সমষ্টিই বুঝাইতেছে। এইরূপ ‘লোকে বলে।’ এখানে লোকে’ অর্থ সর্বসাধারণে। ‘লোক বলে’ কোনোমতেই হয় না। সমষ্টি যখন বুঝায় তখন ‘বানরে বাগান নষ্ট করিয়াছে’ ইহাই ব্যবহার্য—‘বানর করিয়াছে’ বলিলে বানর দল বুঝাইবে না।

সংখ্যা-সহযোগে বিশেষ্যপদ যদিচ সামান্যতা পরিহার করে তথাপি সকর্মক রূপে তাহাদের প্রতিও একার প্রয়োগ হয়, যেমন ‘তিন শেয়ালে যুক্তি করে গর্তে ঢুকল’, এমন—কি ‘আমরা’ ‘তোমরা’ ‘তারা’ ইত্যাদি সর্বনাম বিশেষণের দ্বারা বিশেষ্যপদ বিশেষভাবে নির্দিষ্ট হইলেও সংখ্যার সংস্রবে তাহার তির্যক্‌রূপ গ্রহণ করে। যেমন, ‘তোমরা দুই বন্ধুতে’ ‘সেই দুটো কুকুরে’ ইত্যাদি।

অনেকের মধ্যে বিশেষ একাংশ যখন এমন কিছু করে অপরাংশ যাহা করে না তখন কর্তৃপদে তির্যক্‌রূপ ব্যবহার হয়। যথা ‘তাদের মধ্যে দুজনে গেল দক্ষিণে’—এরূপ বাক্যের মধ্যে একটি অসমাপ্তি আছে। অর্থাৎ আর কেহ আর কোনো দিকে গিয়াছে বা বাকি কেহ যায় নাই এরূপ বুঝাইতেছে। যখন বলি ‘একজনে বললে হাঁ’ তখন ‘আর-একজন বললে না’ এমন আর-একটা কিছু