বাংলা ব্যাকরণের তির্যকরূপ

‘পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়’ এই বাক্যে ‘পাগলে’ ও ‘ছাগলে’ শব্দে যে একার দেখিতেছি তাহা উক্ত প্রকার তির্যক্‌রূপের একার। বাংলা ভাষায় এই শ্রেণীর তির্যক্‌রূপ কোন্‌ কোন্‌ স্থলে ব্যবহৃত হয় আমরা তাহার আলোচনা করিব।

সামান্য বিশেষ্য : বাংলায় নাম সংজ্ঞা (proper names) ছাড়া অন্যান্য বিশেষ্যপদে যখন কোনো চিহ্ন থাকে না, তখন তাহাদিগকে সামান্য বিশেষ্য বলিয়া গণ্য করিতে হইবে। যেমন, বানর, টেবিল, কলম, ছুরি ইত্যাদি।

উল্লিখিত বিশেষ্যপদগুলির দ্বারা সাধারণভাবে সমস্ত বানর, টেবিল, চৌকি, ছুরি বুঝাইতেছে, কোনো বিশেষ এক বা একাধিক বানর, টেবিল, চৌকি, ছুরি বুঝাইতেছে না বলিয়াই ইহাদিগকে সামান্য বিশেষ্য পদ নাম দেওয়া হইয়াছে। বলা আবশ্যক ইংরেজি common names ও বাংলা সামান্য বিশেষ্যে প্রভেদ আছে। বাংলায় আমরা যেখানে বলি ‘এইখানে ছাগল আছে’ সেখানে ইংরেজিতে বলে ‘There is a goat here’ কিংবা ‘There are goats here’। বাংলায় এ স্থলে সাধারণভাবে বলা হইতেছে ছাগলজাতীয় জীব আছে। তাহা কোনো একটি বিশেষ ছাগল বা বহু ছাগল তাহা নির্দেশ করিবার প্রয়োজন ঘটে নাই বলিয়া নির্দেশ করা হয় নাই, কিন্তু ইংরেজিতে এরূপ স্থলেও বিশেষ্যপদকে article-যোগে বা বহুবচনের চিহ্নযোগে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করা হয়। ইংরেজিতে যেখানে বলে ‘There is a bird in the cage’ বা ‘There are birds in the cage’ আমরা উভয় স্থলেই বলি ‘খাঁচায় পাখি আছে’—কারণ এ স্থলে খাঁচার পাখি এক কিংবা বহু তাহা বক্তব্য নহে কিন্তু খাঁচার মধ্যে পাখি নামক পদার্থ আছে ইহাই বক্তব্য। এই কারণে, এ-সকল স্থলে বাংলায় সামান্য বিশেষ্যপদই ব্যবহৃত হয়।

এই সামান্য বিশেষ্যপদ যখন জীববাচক হয় প্রায় তখনই তাহা তির্যকরূপ গ্রহণ করে। কখনো বলি না, ‘গাছে নড়ে’, বলি ‘গাছ নড়ে’। কিন্তু ‘বানরে লাফায়’ বলিয়া থাকি। কেবল কর্তৃকারকেই এই শ্রেণীর তির্যক্‌রূপের প্রয়োগ দেখা যায়, কিন্তু তাহার বিশেষ নিয়ম আছে।

প্লেগে ধরে বা ম্যালেরিয়ায় ধরে—এরকম স্থলে প্লেগ ও ম্যালেরিয়া বস্তুত অচেতন পদার্থ। কিন্তু আমরা বলিবার সময় উহাতে চেতনতা আরোপ করিয়া উহাকে আক্রমণ ক্রিয়ার সচেষ্ট কর্তা বলিয়াই ধরি। তাই উহা রূপকভাবে চেতন বাচকের পর্যায় স্থান লাভ করিয়া তির্যক্‌রূপ প্রাপ্ত হয়।

মোটের উপর বলা যাইতে পারে সকর্মক ক্রিয়ার সহযোগেই জীববাচক সামান্য বিশেষ্যপদ কর্তৃকারকে তির্যক্‌রূপ ধারণ করে। ‘এই ঘরে ছাগলে আছে’ বলি না কিন্তু ‘ছাগলে ঘাস খায়’ বলা যায়। বলি ‘পোকায় কেটেছে’, কিন্তু অকর্মক ‘লাগা’ ক্রিয়ার বেলায় ‘পোকা লেগেছে’। ‘তাকে ভূতে পেয়েছে’ বলি, ‘ভূত পেয়েছে’ নয়। পাওয়া ক্রিয়া সকর্মক।

কিন্তু এই সকর্মক ও অকর্মক শব্দটি এখানে সম্পূর্ণ খাটিবে না। ইহার পরিবর্তে বাংলায় নূতন শব্দ তৈরি করা আবশ্যক। আমরা এ স্থলে ‘সচেষ্টক’ ও ‘অচেষ্টক’ শব্দ ব্যবহার করিব। কারণ প্রচলিত ব্যাকরণ অনুসারে সকর্মক ক্রিয়ার সংস্রবে ঊহ্য বা ব্যক্তভাবে কর্ম থাকা চাই কিন্তু আমরা যে শ্রেণীর ক্রিয়ার কথা বলিতেছি তাহার কর্ম না থাকিতেও পারে। ‘বানরে লাফায়’ এই বাক্যে ‘বানর’ শব্দ তির্যক্‌রূপ গ্রহণ করিয়াছে, অথচ ‘লাফায়’ ক্রিয়ার কর্ম নাই। কিন্তু ‘লাফানো’ ক্রিয়াটি সচেষ্টক।

‘আছে’ এবং ‘থাকে’ এই দুইটি ক্রিয়ার পার্থক্য চিন্তা করিয়া দেখিলে দেখা যাইবে, ‘আছে’ ক্রিয়াটি অচেষ্টক কিন্তু ‘থাকে’ ক্রিয়া সচেষ্টক—সংস্কৃত ‘অস্তি’ এবং ‘তিষ্ঠতি’ ইহার প্রতিশব্দ। ‘আছে’ ক্রিয়ার কর্তৃকারকে তির্যক্‌রূপ স্থান পায় না—‘ঘরে মানুষে আছে’ বলা চলে না কিন্তু ‘এ ঘরে কি মানুষে থাকতে পারে’ এরূপ প্রয়োগ সংগত।

‘প্লেগে স্ত্রীলোকেই অধিক মরে’ এ স্থলে মরা ক্রিয়া অচেষ্টক সন্দেহ নাই। ‘বেশি আদর পেলে ভালো মানুষেও বিগড়ে যায়’ ‘অধ্যবসায়ের দ্বারা মূর্খেও পণ্ডিত হ’তে পারে’, ‘অকস্মাৎ মৃত্যুর আশঙ্কায় বীরপুরুষেও ভীত হয়’ এ-সকল অচেষ্টক ক্রিয়ার দৃষ্টান্তে আমার নিয়ম খাটে না। বস্তুত এই নিয়মে ব্যতিক্রম যথেষ্ট আছে।