সাকার ও নিরাকার
সাকার ও নিরাকার-তত্ত্ব। শ্রীযতীন্দ্রমোহন সিংহ বি.এ. প্রণীত

ঈশ্বর সাকার কি নিরাকার এরূপ তর্ক মধ্যে মধ্যে আমাদের দেশে শুনা যায়। কিন্তু বর্তমান সমালোচ্য গ্রন্থে তর্কটা ততদূর স্থূল নহে। গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এই যে, ঈশ্বরকে সাকার ভাবে উপাসনা করিতে হইবে কি নিরাকার ভাবে।

কেহ কেহ এ প্রশ্নের উত্তর দিয়া থাকেন যে, যে লোক নিরাকারে মন দিতে পারে না তাহার পক্ষে সাকার উপাসনা শ্রেয়।

কিন্তু গ্রন্থকার সেরূপ মাঝামাঝি কিছু বলিতে চাহেন না; তিনি বলেন, নিরাকার উপাসনা হইতেই পারে না। হয় সোহহংব্রহ্ম হইয়া যাও, নয় মূর্তিপূজা করো। তিনি কালাপাহাড়ের ঠিক বিপরীতমুখে সংহারকার্য শুরু করিয়াছেন। মূর্তিপূজাকে কেবল যে তিনি রক্ষা করিতে চান তাহা নহে, অমূর্ত পূজাকে তর্কের দ্বারা ধ্বংস করিতে ইচ্ছা করেন।

কী হইতে পারে এবং কী হইতে পারে না, তর্ক অপেক্ষা ইতিহাসে তাহার প্রমাণ সহজে পাওয়া যায়। জল যে শীতে জমিয়া বরফ হইতে পারে উষ্ণপ্রধান দেশের রাজাকে তাহা তর্কে বুঝানো অসাধ্য; কিন্তু যদি তিনি একবার নড়িয়া হিমালয়প্রদেশে ভ্রমণ করিয়া আসেন তবে এ সম্বন্ধে আর কথা থাকে না। লেখকমহাশয় সে রাস্তায় যান নাই। তিনি তর্কদ্বারা বলিয়াছেন, নিরাকার উপাসনা হইতেই পারে না।

মুসলমানেরা মূর্তিপূজা করে না। অথচ মুসলমান-সম্প্রদায়ের মধ্যে ভক্ত কেহ নাই বা কখনো জন্মেন নাই, এ কথা বিশ্বাস্য নহে। কী করিয়া যে তাঁহাদের ভক্তিবৃত্তির পরিতৃপ্তি হয় তাহা যতীন্দ্রমোহনবাবু না বুঝিতে পারেন কিন্তু মূর্তিপূজা করিয়া নহে এ কথা নিশ্চয়।

নানক যে জগতের ভক্তশ্রেষ্ঠদের মধ্যে একজন নহেন তাহা কেহ সাহস করিয়া বলিবেন না। তিনি যে সোহহংব্রহ্মবাদী ছিলেন না ইহাও নিঃসন্দেহ। তিনি যে প্রচলিত মূর্তি-উপাসনা বিশেষরূপে পরিত্যাগ করিয়া অমূর্ত উপাসনা প্রচার করিয়াছিলেন ইহার একটি বৈ কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। নিশ্চয় তিনি নিরাকার উপাসনায় চরিতার্থতা লাভ করিতেন এবং মূর্তি-উপাসনায় তাহার ব্যাঘাত করিয়াছিল।

ব্রাহ্মদের মধ্যেও নিঃসন্দেহে কেহ-না-কেহ আছেন যিনি প্রবল ভক্তির আবেগ-বশতই মূর্তিপূজা পরিহারপূর্বক সমস্ত জীবন নিরাকার উপাসনায় যাপন করিয়াছেন। গ্রন্থকারের মতে তিনি ভ্রান্ত হইতে পারেন, কিন্তু তিনি যে ভক্ত তাহা কেবল তর্কে নহে, আচরণে এবং বহু পীড়ন ও ত্যাগ স্বীকারে প্রমাণ করিয়াছেন।

এককালে ভারতবর্ষে মূর্তিপূজা ছিল না, কিন্তু সেই দূরকাল সম্বন্ধে ঐতিহাসিক প্রমাণ উত্থাপন করা নিষ্ফল। আধুনিক কালের যে কয়টি উদাহরণ দেওয়া গেল তাহা হইতে অন্তত এটুকু প্রমাণ হয় যে, কোনো কোনো ভক্ত মূর্তিপূজায় বিরক্ত হইয়া তাহা ত্যাগ করিয়াছেন এবং অনেক ভক্ত পৃথিবীর অনেক দেশে অমূর্ত উপাসনায় ভক্তিবৃত্তির পরিতৃপ্তি লাভ করিয়াছেন।

গ্রন্থকার বলেন, মানিলাম তাঁহারা মূর্তিপূজা করেন না কিন্তু তাঁহারা নিরাকার উপাসনা করেন ইহা হইতেই পারে না। কারণ, ‘জাতিবাচক ও গুণবাচক পদার্থ অবলম্বনে ঈশ্বরের জ্ঞান সাকার।’

এ কেমন তর্ক, যেমন– যদি আমি বলি ক বাঁকা পথে চলে এবং খ সোজা পথে চলে তুমি বলিতে পারো খ-ও সোজা পথে চলে না– কারণ সরল রেখা কাল্পনিক; পৃথিবীতে কোথাও সরল রেখা নাই।

কথাটা সত্য বটে কিন্তু তথাপি ইহা তর্কমাত্র। আমাদের ভাষা আমাদের মনকে একদম ছাড়াইয়া যাইতে পারে না; এবং