সাকার ও নিরাকার
আমাদের মন সীমাবদ্ধ। সুতরাং আমাদের ভাষা আপেক্ষিক। আমরা যাহাকে তীক্ষ্ম বলি অণুবীক্ষণ দিয়া দেখিতে গেলে তাহা ভোঁতা হইয়া পড়ে, আমরা যাহাকে নিটোল গোল বলি তাহাকে সহস্রগুণ বাড়াইয়া দেখিলে তাহার অসমানতা ধরা পড়িয়া যায়। অণুবীক্ষণ দিয়া দেখিতে গেলে নিরাকার উপাসনার মধ্যে যে আকারের আভাস পাওয়া যায় না তাহা বলিতে সাহস করি না।

তাই যদি হইল, তবে আমরা যাহাকে সাকার উপাসনা বলি তাহাতেই বা দোষ কী? নিরাকার যখন পূর্ণভাবে মনের অগম্য তখন তাঁহাকে সুগম আকারে পূজা করাই ভালো।

আকার আমাদের মনের পক্ষে সুগম হইতে পারে কিন্তু তাই বলিয়া নিরাকার যে আকারের দ্বারা সুগম হইতে পারেন তাহা নহে– ঠিক তাহার উলটা।

মনে করো, আমি সমুদ্রের ধারণা করিতে ইচ্ছা করি। সমুদ্র ক্রোশ-দুই তফাতে আছে। আমি তাহা দেখিতে যাত্রা করিবার সময় পণ্ডিত আসিয়া বলিলেন, সমুদ্র এতই বড়ো যে সচক্ষে দেখিয়াও তাহার ধারণা হইতে পারে না; কারণ আমাদের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ; আমরা সমুদ্রের মধ্যে যতই দূরে যাই, যতই প্রয়াস পাই, সমুদ্রকে ছোটো করিয়া দেখা ছাড়া উপায়ই নাই। অতএব তোমার অন্দরের মধ্যে একটি ছোটো ডোবা খুঁড়িয়া তাহাকে সমুদ্র বলিয়া কল্পনা করো।

কিন্তু দর্শনশক্তির সাধ্য সীমা দ্বারা সমুদ্র দেখিয়াও যদি সমুদ্রের ধারণা সম্পূর্ণ না হয় তবে ডোবা হইতে সমুদ্রের ধারণা অসম্ভব বলিলেও হয়।

অনন্ত আকাশ আমাদের কাছে মণ্ডলবদ্ধ, কিন্তু তাই বলিয়া ঘরে দ্বার বন্ধ করিয়া আকাশ দেখার সাধ মিটাইতে পারি না। আমি যতদূর পর্যন্ত দেখিতে পাই তাহা না দেখিয়া আমার তৃপ্তি হয় না।

এই যে প্রয়াস, বস্তুত ইহাই উপাসনা। আমার শেষ পর্যন্ত গিয়াও যখন তাঁহার শেষ পাই না, আমার মন যখন একাকী বিশ্বব্রহ্মান্ডের মধ্যে যাত্রা করিয়া বাহির হয়, যখন অগণ্য গ্রহচন্দ্রতারকার অনন্ত জটিল জ্যোতিররণ্যমধ্যে সে হারাইয়া যায়, এবং প্রভাতকরপ্লাবিত নীলাকাশের মহোচ্চদেশে বিলীনপ্রায় বিহঙ্গমের মতো উচ্ছ্বসিতকণ্ঠে গাহিয়া উঠে, আমি ভূমা, আমি তোমার শেষ পাইলাম না–তখন তাহাতেই সে কৃতার্থ হয়। সেই অন্ত না পাইয়াই তাহার সুখ, “ভূমৈব সুখং, নাল্পে সুখমস্তি।”

টলেমির জগৎতন্ত্র আমাদের ধারণাযোগ্য। পৃথিবীকে মধ্যে রাখিয়া বদ্ধ কঠিন আকাশে জ্যোতিষ্কগণ সংকীর্ণ নিয়মে ঘুরিতেছে ইহা ঠিক মনুষ্যমনের আয়ত্তগম্য; কিন্তু অধুনা জ্যোতির্বিদ্যার বন্ধনমুক্তি হইয়াছে, সে সীমাবদ্ধ ধারণার বাহিরে অনন্ত রহস্যের মধ্যে গিয়া পড়িয়াছে বলিয়া তাহার গৌরব বাড়িয়াছে। জগৎটা যে পৃথিবীর প্রাঙ্গণমাত্র নহে,পৃথিবী যে বিশ্বজগতে ধূলিকণার অধম এই সংবাদেই আমাদের কল্পনা প্রসারিত হইয়া যায়।

আমাদের উপাস্য দেবতাকেও যখন কেবলমাত্র মনুষ্যের গৃহপ্রাঙ্গণের মধ্যে বদ্ধ করিয়া না দেখি, তাঁহাকে আমাদের ধারণার অতীত বলিয়া জানি, যখন ঋষিদের মুখে শুনি–

যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ
আনন্দং ব্রহ্মণো বিদ্বান্‌ ন বিভেতি কুতশ্চন

অর্থাৎ মনের সহিত বাক্য যাঁহাকে না পাইয়া ফিরিয়া আসে সেই আনন্দকে সেই ব্রহ্মকে যিনি জানেন তিনি কাহা হইতেও ভয় পান না– তখনই আমাদের বদ্ধ হৃদয় মুক্তির আশ্বাস লাভ করিতে থাকে। বাক্য-মন যাঁহাকে না পাইয়া ফিরিয়া আসে তিনি যে আমাদের পক্ষে শূন্যস্বরূপ তাহা নহে, তিনিই আনন্দ।

যাঁহাকে আমাদের অপেক্ষা বড়ো বলিয়া জানি তাঁহাকেই উপাসনা করি। আমাদের সর্বোচ্চ উপাসনা তিনিই আকর্ষণ করেন যিনি এতবড়ো যে কোথাও তাঁহার শেষ নাই।