লেখার নমুনা

সম্পাদকমহাশয়-সমীপেষু-

ধৃষ্টতা মার্জনা করিবেন, কিন্তু না বলিয়া থাকিতে পারি না, আপনারা এখনো লিখিতে শিখেন নাই। অমন মৃদুসম্ভাষণে কাজ চলে না। গলায় গামছা দিয়া লোক টানিতে হইবে। কিন্তু উপদেশের অপেক্ষা দৃষ্টান্ত অধিক ফলপ্রদ বলিয়া আমাদের এজেন্সি আপিস হইতে একটা লেখার নমুনা পাঠাইতেছি। পছন্দ হইলে ছাপাইবেন, দাম দিতে ভুলিবেন না। যিনি লিখিয়াছেন তিনি সাহিত্যসংসারে একজন সুপরিচিত ব্যক্তি। বাঙ্গালার ভূগোলে সাহিত্যসংসার কোথায় আছে ঠিক জানি না ; এই পর্যন্ত জানি, আমাদের বিখ্যাত লেখককে তাঁহার ঘরের লোক ছাড়া আর কেহই চেনেন না। অতএব অনুমান করা যাইতে পারে, সাহিত্যসংসার বলিতে তিনি, তাঁহার বিধবা পিসি, তাঁহার স্ত্রী এবং দুই বিবাহযোগ্যা কন্যা বুঝায়। এই ক্ষুদ্র সাহিত্যসংসারটির জীবিকা আমাদের খ্যাতনামা লেখকটির উপরেই সম্পূর্ণ নির্ভর করিতেছে, সুতরাং সকল সময়ে রুচি রক্ষা করিয়া, সত্য রক্ষা করিয়া, ভদ্রতা রক্ষা করিয়া লিখিলে ইঁহার কোনোমতে চলে না ; অতএব উপযুক্ত লেখক এমন আর পাইবেন না।

 

তবু কেন বলি

 

দেখিয়া বিস্মিত আশ্চর্য এবং চমৎকৃত হইতে হয়, কী বলিব, চক্ষে জল আসে, কান্না পায়, অশ্রুসলিলে বক্ষ ভাসিয়া যায়, যখন দেখিতে পাই, যখন প্রত্যহ এমন-কি, প্রতিদিন প্রত্যক্ষ দেখা যায়–কী দেখা যায়! পোড়া মুখে কেমন করিয়া বলিব কী দেখা যায়! বলিতে লজ্জা হয়, শরম আসে, মুখ ঢাকিতে ইচ্ছা হয়, উচ্চৈঃস্বরে ডাক ছাড়িয়া বলিতে ইচ্ছা করে, মাতঃ বসুন্ধরে, জননী, মা, মা গো, একবার দ্বিধা হও মা-একবার দুখানা হইয়া ভাঙিয়া যা মা, সন্তানের লজ্জা নিবারণ কর্ জননী। ভাই বঙ্গবাসী, বুঝিয়াছ কি, কোন্‌ কলঙ্কের কথা, কোন্‌ লাঞ্ছনার কথা, কোন্‌ দুঃসহ লজ্জার কথা বলিতেছি, ব্যক্ত করিতেছি, প্রকাশ করিতে গিয়া কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া যাইতেছে? না, বোঝ নাই, তোমরা বুঝিবে কেন ভাই? তোমরা মিল্‌ বোঝ, স্পেন্সর বোঝ, তোমরা শেলির আধো-আধো ছায়া-ছায়া ভাঙা-ভাঙা কবিত্ব বোঝ, তোমরা গরিবের কথা বুঝিবে কেন, দরিদ্রের কথা শুনিবে কেন, এ অকিঞ্চনের ভাষা তোমাদের কানে যাইবে কেন? কিন্তু ভাই, একটি প্রশ্ন আছে, একটি কথা জিজ্ঞাসা করিব, গুণমণি, ওই মুখের একটি উত্তর শুনিতে চাই–আচ্ছা ভাই, পরের কথা বোঝ, আর আপনার লোকের কথা বোঝ না, বাহিরের কথা বোঝ আর ঘরের কথা বুঝিতে পার না, যে আপনার নয় তাহার কথা বোঝ–যে আপনার তাহার কথা বোঝ না? বোঝ না তাহাতেও দুঃখ নাই, তাহাতেও খেদ নাই, তাহাতেও তিলার্ধমাত্র শোকের কারণ নাই, কিন্তু ভাই, কথাটা যে একেবারেই হৃদয়ঙ্গমই হয় না, একেবারে যেন অবোধের মতো বসিয়া থাক! সেই তো আমাদের দুর্দশা, সেই তো আমাদের দুরদৃষ্ট। ভাই বাঙালি, জিজ্ঞাসা করিতে পার বটে, যে কথা আজিকার দিনে কেহ বুঝিবে না সে কথা তুলিলে কেন, উত্থাপন করিলে কেন? যে কথা সবাই ভুলিয়াছে সে কথা মনে করাইয়া দাও কেন? যে দুর্বিষহ বেদনা, যে দুঃসহ ব্যথা, যে অসহ্য যন্ত্রণা নাই তাহাতে আঘাত দাও কেন? আমিও তো সেই কথা বলি ভাই। এই ভাঙা মন্দিরে এই ভাঙা কণ্ঠের প্রতিধ্বনি কেন তুলি! এই শ্মশানের চিতানলে আবার কেন নূতন করিয়া নয়নজল নিক্ষেপ করি! আর্যজননীর সমাধিক্ষেত্রে এই ঊনবিংশ শতাব্দীর সভ্যশাসিত সভ্যচালিত নবসভ্যতার দিনে আবার কেন নূতন করিয়া নীরবতার তরঙ্গ উত্থিত করি! কেন করি! তোমরা কী করিয়া বুঝিবে ভাই, কেন