চণ্ডালিকা
আমার সর্বস্ব, তুমি এসেছ— আমার সমস্ত অপমানের চূড়ায় তোমাকে বসাব, গাঁথব তোমার সিংহাসন। আমার লজ্জা দিয়ে, ভয় দিয়ে, আনন্দ দিয়ে।

মা। সময় হয়ে আসছে আমার। আর পারছি নে। শিগ‌্‍গির দেখ্‌ তোর আয়নাটা।

প্রকৃতি। মা, ভয় হচ্ছে। তাঁর পথ আসছে শেষ হয়ে— তার পরে? তার পরে কী। শুধু এই আমি! আর কিচ্ছু না। এতদিনের নিষ্ঠুর দুঃখ এতেই ভরবে? শুধু আমি? কিসের জন্যে এত দীর্ঘ, এত দুর্গম পথ! শেষ কোথায় এর! শুধু এই আমাতে!

গান

পথের     শেষ কোথায়, শেষ কোথায়,

                কী আছে শেষে।

এত কামনা এত সাধনা কোথায় মেশে।

     ঢেউ ওঠে-পড়ে কাঁদার,

     সম্মুখে ঘন আঁধার—

                পার আছে কোন্‌ দেশে।

                আজ ভাবি মনে মনে,

                মরীচিকা-অন্বেষণে

     বুঝি তৃষ্ণার শেষ নেই—

     মনে ভয় লাগে সেই,

       হাল-ভাঙা পাল-ছেঁড়া ব্যথা

                চলেছে নিরুদ্দেশে॥

মা। ও নিষ্ঠুর মেয়ে, দয়া কর্ আমাকে, আমার আর সহ্য হয় না। শিগ‌্‍গির আয়নাটা দেখ্‌।

প্রকৃতি। (আয়নাটা দেখেই ফেলে দিল) মা, ওমা, ওমা রাখ্‌ রাখ্‌ রাখ্‌ রাখ্‌, ফিরিয়ে নে ফিরিয়ে নে তোর মন্ত্র! এখনি, এখনি। ওরে ও রাক্ষুসী, কী করলি, কী করলি, তুই মরলি নে কেন! কী দেখলেম! ওগো, কোথায় আমার সেই দীপ্ত উজ্জ্বল, সেই শুভ্র নির্মল, সেই সুদূর স্বর্গের আলো! কী ম্লান, কী ক্লান্ত, আত্মপরাজয়ের কী প্রকাণ্ড বোঝা নিয়ে এল আমার দ্বারে! মাথা হেঁট করে এল! যাক্‌, যাক, এ-সব যাক (পা দিয়ে মন্ত্রের উপকরণ ভেঙে ছড়িয়ে ফেললে)— ওরে, তুই চণ্ডালিনী না হোস যদি, অপমান করিস নে বীরের। জয় হোক তাঁর জয় হোক।

আনন্দের প্রবেশ

প্রভু, এসেছ আমাকে উদ্ধার করতে— তাই এত দুঃখই পেলে— ক্ষমা করো, ক্ষমা করো। অসীম গ্লানি পদাঘাতে দূর করে দাও। টেনে এনেছি তোমাকে মাটিতে, নইলে কেমন করে আমাকে তুলে নিয়ে যাবে তোমার পুণ্যলোকে! ওগো নির্মল, পায়ে তোমার ধুলো লেগেছে, সার্থক হবে সেই ধুলো-লাগা। আমার মায়া-আবরণ পড়বে খসে তোমার পায়ে, ধুলো সব নেবে মুছে। জয় হোক, তোমার জয় হোক, তোমার জয় হোক!

মা। জয় হোক, প্রভু। আমার পাপ আর আমার প্রাণ দুই পড়ল তোমার পায়ে, আমার দিন ফুরল ঐখানেই—তোমার ক্ষমার তীরে এসে।