প্রায়শ্চিত্ত
প্রথম অঙ্ক
উদয়াদিত্যের শয়নকক্ষ
উদয়াদিত্য ও সুরমা

উদয়াদিত্য। যাক চুকল!

সুরমা। কী চুকল?

উদয়াদিত্য। আমার উপর মাধবপুর পরগনা শাসনের ভার মহারাজ রেখেছিলেন। জান তো, দু-বৎ সর থেকে সেখানে কী রকম অজন্মা হয়েছে — আমি তাই খাজনা আদায় বন্ধ করেছিলুম। মহারাজ আমাকে বলেছিলেন যেমন করে হোক টাকা চাই।

সুরমা। আমি তো তোমাকে আমার গহনাগুলো দিতে চেয়েছিলুম।

উদয়াদিত্য। তোমার গহনা টাকা দিয়ে কেনে এত বড়ো বুকের পাটা এ-রাজ্যে আছে কার? মহারাজার কানে গেলে কি রক্ষা আছে? আমি মহারাজকে বললুম মাধবপুর থেকে টাকা আমি কোনোমতেই আদায় করতে পারব না। শুনে তিনি মাধবপুর আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন। তিনি এখন সৈন্য বাড়াচ্ছেন, টাকা তাঁর চাই।

সুরমা। পরগনা তো কেড়ে নিলেন, কিন্তু তুমি চলে এলে প্রজারা যে মরবে।

উদয়াদিত্য। আমি ঠিক করেছি, যে করে হোক তাদের পেটের ভাতটা জোগাব। শুনতে পেলে মহারাজ খুশি হবেন না — দয়া জিনিসটাকে তিনি মেয়েমানুষের লক্ষণ বলেই জানেন। কিন্তু তোমার ঘরে আজ এত ফুলের মালার ঘটা কেন?

সুরমা। রাজপুত্রকে রাজসভায় যখন চিনল না, তখন যে তাকে চিনেছে সে তাকে মালা দিয়ে বরণ করবে।

উদয়াদিত্য। সত্যি নাকি! তোমার ঘরে রাজপুত্র আসাযাওয়া করেন? তিনি কে শুনি? এ খবরটা তো জানতুম না।

সুরমা। রামচন্দ্র যেমন ভুলেছিলেন তিনি অবতার, তোমারও সেই দশা হয়েছে। কিন্তু ভক্তকে ভোলাতে পারবে না।

উদয়াদিত্য। রাজপুত্র! রাজার ঘরে কোনো জন্মে পুত্র জন্মাবে না, বিধাতার এই অভিশাপ।

সুরমা। সে কী কথা?

উদয়াদিত্য। হাঁ, রাজার ঘরে উত্তরাধিকারীই জন্মায়, পুত্র জন্মায় না।

সুরমা। এ তুমি মনের ক্ষোভে বলছ।

উদয়াদিত্য। কথাটা কি আমার কাছে নূতন যে ক্ষোভ হবে? যখন এতটুকূ ছিলুম তখন থেকে মহারাজ এইটেই দেখেছেন যে আমি তাঁর রাজ্যভার বইবার যোগ্য কি না। কেবলই পরীক্ষা, স্নেহ নেই!

সুরমা। প্রিয়তম, দরকার কী স্নেহের! খুব কঠোর পরীক্ষাতেও তোমার জিত হবে। তোমার মতো রাজার ছেলে কোন্‌ রাজা পেয়েছে?

উদয়াদিত্য। বল কী? পরীক্ষক তোমার পরামর্শ নিয়ে বিচার করবেন না, সেটা বেশ বুঝতে পারছি।

সুরমা। কারও পরামর্শ নিয়ে বিচার করতে হবে না — আগুনের পরীক্ষাতেও সীতার চুল পোড়ে নি। তুমি রাজ্যভার বহনের উপয়ুক্ত নও, এ-কথা কি বললেই হল? এতবড়ো অবিচার কি জগতে কখনো টিকতে পারে?

উদয়াদিত্য। রাজ্যভারটা নাই-বা ঘাড়ের উপর পড়ল, তাতেই বা দুঃখ কিসের?