চিরকুমার-সভা

চন্দ্রবাবু। ভালো প্রস্তাবমাত্রেই তাঁর উৎ সাহ দেখে আমি আশ্চর্য হয়েছি।

নির্মলা। তা ছাড়া, তাঁকে দেখবামাত্র তাঁর মনের মাধুর্য মুখে এবং চেহারায় কেমন স্পষ্ট বোঝা যায়।

চন্দ্রবাবু। এত অল্প কালের মধ্যেই যে কারো প্রতি এত গভীর স্নেহ জন্মাতে পারে তা আমি কখনো মনে করি নি। আমার ইচ্ছা করে, ঐ ছেলেটিকে নিজের কাছে রেখে ওর সকলপ্রকার লেখাপড়ায় এবং কাজে সহায়তা করি।

নির্মলা। তা হলে আমারও ভারি উপকার হয়, অনেক কাজ করতে পারি। আচ্ছা, এরকম প্রস্তাব করে একবার দেখোই - না — ঐ - যে বেহারা আসছে। বোধ হয় তিনি লেখাটা পাঠিয়ে দিয়েছেন। রামদীন, চিঠি আছে? এই দিকে নিয়ে আয়।

বেহারার প্রবেশ

ও চন্দ্রবাবুর হাতে চিঠি - প্রদান

 

মামা, সেই প্রবন্ধটা নিশ্চয় তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন, ওটা আমাকে দাও।

চন্দ্রবাবু। না ফেনি, এটা আমার চিঠি।

নির্মলা। তোমার চিঠি! অবলাকান্তবাবু বুঝি তোমাকেই লিখেছেন? কী লিখেছেন।

চন্দ্রবাবু। না, এটা পূর্ণর লেখা।

নির্মলা। পূর্ণবাবুর লেখা? ওঃ —

চন্দ্রবাবু। পূর্ণ লিখছেন — ‘গুরুদেব, আপনার চরিত্র মহৎ, মনের বল অসামান্য ; আপনার মতো বলিষ্ঠপ্রকৃতি লোকেই মানুষের দুর্বলতা ক্ষমার চক্ষে দেখিতে পারেন ইহাই মনে করিয়া অদ্য এই চিঠিখানি আপনাকে লিখিতে সাহসী হইতেছি। '

নির্মলা। হয়েছে কী। বোধ হয় পূর্ণবাবু চিরকুমার - সভা ছেড়ে দেবেন, তাই এত ভূমিকা করছেন। লক্ষ্য করে দেখেছ বোধ হয়, পূর্ণবাবু আজকাল কুমার - সভার কোনো কাজই করে উঠতে পারেন না।

চন্দ্রবাবু। ‘দেব, আপনি যে আদর্শ আমাদের সম্মুখে ধরিয়াছেন তাহা অত্যুচ্চ, যে উদ্দেশ্য আমাদের মস্তকে স্থাপন করিয়াছেন তাহা গুরুভার — সে আদর্শ এবং সেই উদ্দেশ্যের প্রতি এক মুহূর্তের জন্য ভক্তির অভাব হয় নাই, কিন্তু মাঝে মাঝে শক্তির দৈন্য অনুভব করিয়া থাকি তাহা চরণসমীপে সবিনয়ে স্বীকার করিতেছি। ‘

নির্মলা। আমার বোধ হয়, সকল বড়ো কাজেই মানুষ মাঝে মাঝে আপনার অক্ষমতা অনুভব করে হতাশ হয়ে পড়ে, শ্রান্ত মন এক - একবার বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, কিন্তু সে কি বরাবর থাকে।

চন্দ্রবাবু। ‘সভা হইতে গৃহে ফিরিয়া আসিয়া যখন কার্যে হাত দিতে যাই তখন সহসা নিজেকে একক মনে হয়, উৎসাহ যেন আশ্রয়হীন লতার মতো লুণ্ঠিত হইয়া পড়িতে চাহে। ' — নির্মল, আমরা তো ঠিক এই কথাই বলছিলেম।

নির্মলা। পূর্ণবাবু যা লিখেছেন সেটা সত্য — মানুষের সঙ্গ না হলে কেবলমাত্র সংকল্প নিয়ে উৎ সাহ জাগিয়ে রাখা শক্ত।

চন্দ্রবাবু। ‘আমার ধৃষ্টতা মার্জনা করিবেন, কিন্তু অনেক চিন্তা করিয়া এ কথা স্থির বুঝিয়াছি, কুমারব্রত সাধারণ লোকের জন্য নহে — তাহাতে বল দান করে না, বল হরণ করে। স্ত্রী পুরুষ পরস্পরের দক্ষিণ হস্ত — তাহারা মিলিত থাকিলে তবেই সম্পূর্ণরূপে সংসারের সকল কাজের উপযোগী হইতে পারে। '

তোমার কী মনে হয় নির্মল। ( নির্মলা নিরুত্তর ) অক্ষয়বাবুও এই কথা নিয়ে সেদিন আমার সঙ্গে তর্ক করছিলেন — তাঁর অনেক কথার উত্তর দিতে পারি নি।