কালের যাত্রা
শূদ্রদলের প্রবেশ

মন্ত্রী। ( দলপতির প্রতি ) এই যে সর্দার। তোমাদের দেখে বড়ো খুশি হলুম।

দলপতি। মন্ত্রীমশায়, আমরা বাবার রথ চালাতে এসেছি।

মন্ত্রী। চিরদিন তোমরাই তো বাবার রথ চালিয়ে এসেছ, আমরা তো উপলক্ষমাত্র। সে কি আর জানি নে।

দলপতি। এতদিন আমরা রথের চাকার তলায় পড়েছি, আমাদের দ'লে দিয়ে রথ চলে গেছে। এবার তো আমাদের বলি বাবা নিল না।

মন্ত্রী। সে তো দেখতে পাচ্ছি। আজ ভোরবেলায় তোমাদের পঞ্চাশজন চাকার সামনে ধুলোয় লুটোপুটি করলে — তবু চাকার মধ্যে একটুও ক্ষুধার লক্ষণ দেখা গেল না, নড়ল না, ক্যাঁ কোঁ করে চীৎ কার করে উঠল না — তাদের স্তব্ধতা দেখেই তো ভয় পেয়েছি।

দলপতি। এবারে রথের তলাটাতে পড়বার জন্যে মহাকাল আমাদের ডাক দেন নি — তিনি ডেকেছেন তাঁর রথের রশিটাকে টান দিতে।

পুরোহিত। সত্যি নাকি। কেমন করে জানলে।

দলপতি। কেমন করে জানা যায় সে তো কেউ জানে না। কিন্তু আজ ভোরবেলা থেকেই আমাদের মধ্যে হঠাৎ এই কথা নিয়ে কানাকানি পড়ে গেছে। ছেলেমেয়ে বুড়ো জোয়ান সবাই বলছে ‘ বাবা ডেকেছেন '।

সৈনিক। রক্ত দেবার জন্যে।

দলপতি। না, টান দেবার জন্যে।

পুরোহিত। দেখো বাবা, ভালো করে ভেবে দেখো, সমস্ত সংসার যারা চালায় মহাকালের রথের রশির জিম্মে তাদেরই ‘ পরে।

দলপতি। ঠাকুর, সংসার কি তোমরাই চালাও।

পুরোহিত। তা দেখো, কাল খারাপ বটে, তবু হাজার হোক আমরা তো ব্রাহ্মণ বটে।

দলপতি। মন্ত্রীমশায়, সংসার কি তোমরাই চালাও।

মন্ত্রী। সংসার বলতে তো তোমরাই। নিজগুণে চল, আমরা চালাক লোকেরা বলে থাকি আমরাই চালাচ্ছি। তোমাদের বাদ দিলে আমরা কজনই বা আছি।

দলপতি। আমাদের বাদ দিলে তোমরা যে কজনাই থাকো-না, থাকবে কী উপায়ে?

মন্ত্রী। হাঁ, হাঁ, সে তো ঠিক কথা।

দলপতি। আমরাই তো জোগাচ্ছি অন্ন, তাই খেয়ে তোমরা বেঁচে আছ। আমরাই বুনছি বস্ত্র, তাতেই তোমাদের লজ্জারক্ষা।

সৈনিক। সর্বনাশ! এতদিন এরা আমাদেরই কাছে হাত জোড় করে বলে আসছিল ‘ তোমরাই আমাদের অন্নবস্ত্রের মালিক '। আজ এ কী রকমের সব উলটো বুলি। আর তো সহ্য হয় না।

মন্ত্রী। ( সৈনিকের প্রতি ) চুপ করো। ( দলপতিকে ) সর্দার, আমরা তো তোমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলুম। মহাকালের বাহন তোমরাই, সে কথা আমরা বুঝিনে, আমরাকি এত মূঢ়। তোমাদের কাজটা তোমরা সাধন করে দিয়ে যাও, তার পরে আমাদের কাজ করবার অবসর আমরা পাব।

দলপতি। আয় রে ভাই, সবাই মিলে টান দে। মরি আর বাঁচি আজ মহাকালের রথ নড়ারই।